1. admin@pathagarbarta.com : admin :
বৃহস্পতিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০২:৩৪ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
মধ্যনগরে অজিৎ স্মৃতি পাঠাগারে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস উদযাপন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস পালিত কিশোরগঞ্জের এনভাইরনমেন্টাল সাইন্স ক্লাব ও পাঠাগারে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস উদযাপন স্মরণ: জননেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের  মতিয়ার চৌধুরী  জাগ্রত আছিম গ্রন্থাগারের উদ্যোগে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস পালিত  গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায় জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস পালিত  নবীগঞ্জের ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রী রবীন্দ্র চন্দ্র দাস গ্রন্থাগার’-এ জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস পালিত মরমী সাধক রাধারমণ দত্তের লেখনী থেকে গোপন চক্রবর্তীর পরিবেশনা ‘বাঁশীরে’ ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা রবীন্দ্র চন্দ্র দাস গ্রন্থাগার’- এর ‘ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ফোরাম’-এর নতুন কমিটি গঠন বেসরকারি গ্রন্থাগারের নির্দেশিকা শীর্ষক ওয়েব-বেইজড সফটওয়্যার উদ্বোধনী অনুষ্ঠিত

স্মরণ: জননেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের  মতিয়ার চৌধুরী 

পাঠাগার বার্তা
  • আপডেট সময় : বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
  • ১৮ বার পঠিত

স্মরণ: জননেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত
মতিয়ার চৌধুরী

আজ ভাটিবাংলার সিংহ পুরুষ দেশের শ্রেষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান জননেতা বাবু সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী। ষাটের দশকের উত্তাল রাজনীতি থেকে উঠে আসা এই নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছেন জাতীয় রাজনীতিতে। দীর্ঘ ৫৯ বছর রাজনীতি করেছেন দাপটের সঙ্গে, যে কোনো জটিল বিষয় হাস্যরসের মাধ্যমে তুলে ধরার অসামান্য ক্ষমতা ছিল এই রাজনীতিকের। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১৯৪৫ সালের ৫ মে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার আনোয়ারপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ২০১৭ সালের এই দিনে তিনি রাজধানী ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি ৭ বার জাতীয় সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। মহান মুক্তিযুদ্ধ, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন এই রাজনীতিক। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৫ নম্বর সেক্টরের অধীন প্রথমে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে প্রথম সাবসেক্টর কমান্ডার ও পরে সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে স্রোতের বিপরীতে ন্যাপের প্রার্থী হিসেবে দিরাই থেকে প্রথম প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। তখন সমগ্র বাংলাদেশে নৌকার জোয়ার, এই নেতা এতটাই জনপ্রীয় ছিলেন সাবেক মন্ত্রী বাবু অক্ষয় কুমার দাসকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে বিজয়ী হন। তখন সমগ্র বাংলাদেশে মাত্র ২সিট বাদে সবকটিতে আওয়ামীলগীগ জয়লাভ করে। বৃহত্তর সিলেটে তখন তিনি এবং নবীগঞ্জ থেকে সতন্ত্র পার্থি হিসেবে নবীগঞ্জ জে-কে উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল আজিজ চৌধুরী বিজয়ী হয়ে জাতিকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।

লন্ডনে বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সাথে লেখক।

স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে উল্টোস্রোতে জীবন কাটানো এক ভাগ্য বিড়ম্বিত জননায়ক বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। রাজনীতিতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের উত্থান যেমন স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তেমনি জীবনের শেষ পর্যায়ে এসেও তাঁর সংগ্রামী জীবনের ইতি টানতে হয়েছে চরম প্রতিকূলতার মাধ্যমে। ষাটের দশকের আন্দোলন, সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় অর্জিত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে যেমন চরম প্রতিক্রিয়াশীল অপরাজনীতি মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হয়েছে। তেমনি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকেও সাম্প্রদায়িকতা, কুপমুন্ডকতা, ষড়যন্ত্র আর গোষ্ঠীতন্ত্র মোকাবিলা করে রাজনীতি করতে হয়েছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। ছোট দলের বড় নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বিভিন্ন সরকারের মন্ত্রী হওয়ার ডাক পেয়েছেন। কিন্তু আদর্শচ্যুত হননি। আত্ম মনোবলে বিভিন্ন সময় উচ্চারণ করেছেন ” কোটায় মন্ত্রী হতে চাইলে বহু আগেই মন্ত্রী হতে পারতাম।

বাংলাদেশের বিকাশ ও সংসদীয় রাজনীতির স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের রাজনীতির ঘাত প্রতিঘাতের যথাযথ চিত্র ফুটে উঠে আপন মহিমায়। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের রাজনৈতিকঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশের রাজনীতির যেন এক রূপান্তরের চিত্র। বৈচিত্র্যময় দলিল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দেশের একমাত্র রাজনীতিবিদ যার জন্য বাংলাদেশে প্রথম বিভিন্ন পদ সৃজন করা হয়। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তাঁকে মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্ঠা করা হয়েছিল। এর আগে এমন পদে কাউকে আসিন হতে দেখা যায়নি। ২০১১ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে ভেঙ্গে নতুন রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। মন্ত্রণালয়টির প্রথম দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। পরবর্তীতে তিনিই প্রথম দফতর বিহীন মন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করেন।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পারিবারিক তথ্যানুযায়ী, তাঁর জন্ম ১৯৩৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি, সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার আনোয়ারপুর গ্রামে। অবশ্য তাঁর পাসপোর্টে জন্ম সাল ১৯৪৫ সালের ৫ মে এবং জাতীয় সংসদে থাকা সংসদ সদস্যদের জীবন বৃত্তান্তে ১৯৪৬ সাল লেখা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর করে ঢাকা সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে আইনে ডিগ্রি নেন সুরঞ্জিত। পরে কিছুদিন আইন পেশায়ও যুক্ত ছিলেন। ছাত্র জীবনেই তিনি বামপন্থী রাজনীতির মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ভিপি প্রার্থী হয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) পিকিং ও মস্কো ধারায় দুই ভাগ হলে সুরঞ্জিত সেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপে যোগ দেন। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে তিনি ন্যাপের প্রার্থী হিসেবে কুড়েঘর প্রতিক নিয়ে তৎকালীন সিলেট-২ আসন থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ৫ নম্বর সাব সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব গ্রহন করেন। ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থী আব্দুস সামাদ আজাদের কাছে পরাজিত হন। ১৯৭৯ সালে দেশের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার প্রতিষ্ঠিত দল একতা পার্টি থেকে সংসদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে তৃতীয় ও ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদে তিনি গণতন্ত্রী পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ছোট দলের বড় নেতা হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিত সুরঞ্জিত আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার পর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে সুনামগঞ্জ ২ আসনে হেরে গিয়েছিলেন। পরে হবিগঞ্জ ২ আসনে উপনির্বাচনে বিজয়ী হন তিনি। পরবর্তীতে ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে তিনি সুনামগঞ্জ ২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন কমিটির কো- চেয়ারম্যান ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অবসান হয় অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির এক দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বের।

রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করতে যিনি ছিলেন উচ্চকিত তাঁকেও ষড়যন্ত্র ও অপ রাজনীতির কবলে পড়ে হতে হয়েছে বিতর্কিত, সমালোচিত। নিখাদ সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য তাঁর ছিল দীর্ঘ লড়াই। রাজনীতিটা যেন রাজনীতিবিদের হাতে থাকে এজন্য দলের ভেতরে, বাইরে তিনি সোচ্চার ছিলেন। বর্তমানে যখন সংবিধানের পুর্নলিখন, সংশোধন, পরিমার্জন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা – সমালোচনা হয় তখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অনুপস্থিতি গভীরভাবে অনুভূত হয়। গণপরিষদের সদস্য হিসেবে সংবিধান সভার তাঁর বক্তব্যগুলো প্রাসঙ্গিক হয়ে ধরা পড়ে। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নতি ও দলগুলোর মধ্যে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন। বাহাত্তরের সংবিধানের মূল নীতি থেকে প্রতিটি সরকার যখন বিচ্যুত হয়েছে তখন তিনি কঠোর সমালোচনা করেছেন। নিজেকে সংস্কারবাদী আখ্যায়িত করে ভবিষ্যত রাজনীতির জন্য বিভিন্ন ফোরামে তিনি যে বক্তব্যগুলো রেখেছিলেন তাই যেন এখন বাস্তব রূপ নিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে তৎকালীন জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির উদ্দেশ্যে তিনি যে বক্তব্য রেখেছিলেন সেখানে দেশের ভবিষ্যত গণতন্ত্র নিয়ে শংকা ও উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেছিলেন। বিএনপিকে সংবিধান সংশোধন কমিটিতে অংশগ্রহণ করে আলোচনা বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রাখার পক্ষে আদালতে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেদিন তিনি যে আশংকা ব্যক্ত করেছিলেন ২০১৪ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ যেন সে পথেই হাঁটতে থাকে।

বার বার দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রা বাধাগ্রস্ত, সংবিধান ক্ষত বিক্ষত, রাজনীতি কলুষিত হওয়ার কথা তিনি উচ্চারণ করতেন ভগ্ন হৃদয়ে, দূরদর্শী চিন্তা থেকে। ব্যক্তিগত সহকারীর কেলেংকারীতে পড়ে তিনি বাংলাদেশে প্রথম ব্যক্তি যিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। ঘোষণা দিয়েছিলেন তদন্তকারী সংস্থা কর্তৃক নির্দোষ প্রমানিত না হলে আর রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন না। পরে তাই করেছিলেন। সরকারের অংশ হয়েও তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন বলে ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন। দল ও সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা অশুভ চক্রের বিরুদ্ধে কথা বলে তিনি অনেকের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। নিজেই উচ্চারণ করেছিলেন”সারা জীবন রাজনীতি করে কেবল বন্ধু নয়, অনেক শত্রুও তো সৃষ্টি করেছি “। ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেনের সময় অন্য কয়েকজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদের মতো তিনিও সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করে দলের ভেতরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা নিশ্চিত করা, যৌথ নেতৃত্বের মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী না হওয়া, দলের প্রধান হলে সরকার প্রধান না হওয়া এমনসব প্রস্তাব গণমাধ্যমে তুলে ধরে তিনি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের আস্থা হারান। কর্মীদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েন। এরজন্য তাকে রাজনৈতিকভাবে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। ২০১২/১৩ সালে শেয়ার বাজার কেলেংকারি যখন তুমুল আলোচনায়। শেয়ার বাজারে সর্বস্ব খুঁইয়ে পথে বসা বিনিয়োগকারীদের যখন হাহাকার চলছে। সেই সময় এসব কেলেংকারির সঙ্গে যার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত তাকেই যখন শেয়ার বাজার তদারকিতে বসানো হয় তখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কটাক্ষ করে বলেছিলেন, “শুঁটকির বাজারে আজ বিড়াল চৌকিদার।” আজকে যখন “দরবেশ ” নাম নিয়ে অনেক নব্য বিপ্লবী তৃপ্তির ঢেকুর তুলেন। তখন হয়তো তারা ভুলে যান এই “দরবেশ ” নামটিও ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দেওয়া খেতাব। দল করে দলের বিভিন্ন অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া, সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করা আবার দলের শৃঙ্খলার স্বার্থে দলের নেতৃত্বের প্রতি অবিচল থাকা এসব ছিল সুরঞ্জিত চরিত্রের বড় গুন। সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের সমালোচনায় মুখর থাকা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে প্রথম বারের মতো রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হলে বলেছিলেন, রেলের কালো বিড়াল বের করাই তাঁর প্রথম কাজ। তাঁর মন্ত্রীত্ব ও ক্ষমতা অনেকের জন্য অস্বস্তির কারণ হয় এবং কিছু দিনের মধ্যে তাঁর মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত সহকারীর আর্থিক কেলেংকারির কারণে দায়বদ্বতার জায়গা থেকে তিনি মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগের এক সময়ের প্রেসিডিয়াম সদস্য, ২০০৯ সাল থেকে উপদেষ্ঠা পরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দলীয় ফোরামে যে অপ্রিয় কথাগুলো বলতেন তা যদি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব আমলে নিতেন তা হলে আজ দলের এমন করুণ পরিণতি হতো না। দলের ভেতর আমলাতন্ত্রের প্রভাব বিস্তার, ব্যবসায়ীদের আধিপত্য, দলীয় প্রার্থী মনোনয়নে অযোগ্যদের প্রাধান্য ও সাংগঠনিক দুর্বলতা নিয়ে তিনি নানা সময় প্রশ্ন তুলেছেন। “এমপি কি কেছকি মাছের ভাগা “এমন সব বক্রোক্তি করে তিনি রাজনীতির গুণগত মান নিয়ন্ত্রণের কথা বলতেন। দেশের গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক রাজনীতির প্রতি দৃঢ় অঙ্গিকারে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়বদ্ধতা নিয়ে তিনি বিভিন্ন সময় যে প্রশ্ন তুলতেন তাই যেন আজ নিষ্ঠুরভাবে বাস্তব হয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বভাবসুলভ রসবোধ আর যুক্তিপূর্ণ বাগ্মিতায় তিনি পৌঁছেছিলেন অনন্য উচ্চতায়। তিনি ছিলেন সত্যিকারের মাটি ও মানুষের নেতা। মানুষের মনের ভাষা তিনি পড়তে পারতেন। মানুষকে উজ্জিবিত করাই ছিল যেন তাঁর প্রশান্তি। রাজনৈতিক সকল সংকটে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে ছুটে যেতেন। মানুষের সমর্থন নিয়ে তিনি প্রথাবিরোধী হুংকার দিতেন আপন মহিমায়। আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন ও গণতন্ত্র বিকাশে ছিলেন সোচ্চার কন্ঠ। দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চায়, সরকারের মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর দৌরাত্ম্যে তিনি ছিলেন উচ্চকন্ঠ।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ। সংবিধান বিশেষজ্ঞ এই নন্দিত পার্লামেন্টারিয়ানের সাহিত্য,সংস্কৃতির প্রতি ছিল গভীর অনুরাগ। বক্তব্য, বিবৃতিতে তিনি প্রায়শই কবিতার পংক্তি ব্যবহার করতেন। সাধারণ মানুষের ভাষা রপ্ত করা, সাহিত্যের রসবোধ আর প্রখর মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন জননেতা ছিলেন তিনি। তেজ ও নাটকীয়তায় ভরা বক্তব্যে তিনি সংসদ থেকে জনসভা সর্বত্র মুগ্ধতা ছড়াতেন। রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সময় নানা ষড়যন্ত্র আর উল্টোস্রোতে সাঁতার কেটে হয়ে উঠেছিলেন একজন সংগ্রামী। স্বভাবসুলভ বিপ্লবী। অমিত সাহস নিয়ে কথা বলতেন যুক্তিপূর্ণ মুক্তচিন্তায়। হাস্যরসাত্বক ভাবে সহজ ভাষায় কঠিন আক্রমন করতেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে। শিল্পীত প্রকাশে ঘায়েল করতেন বিরোধীপক্ষকে। সরকারি দল, বিরোধীদল সব অবস্থানেই তিনি মন্ত্রী, আমলাদের বিরুদ্ধে টিপ্পনি কাটতেন। অসঙ্গতির বিরুদ্ধে কথা বলতেন। এজন্য তাঁকে কম মূল্য দিতে হয়নি। বিভিন্নভাবে অবমূল্যায়িত হলেও কষ্ট চেপে রাখতেন ।

রেলমন্ত্রী থাকাকালীন নিজ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত সহকারীর আর্থিক কেলেংকারিতে তিনি আহত হয়েছিলেন। প্রশাসন ও মিডিয়ার ভূমিকায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। সংবাদ মাধ্যমে তাকে জড়িয়ে কাল্পনিক প্রতিবেদনে তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন। অনেকটা স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান। যা পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় উচ্চারণ করেছেন। তদন্তের মাধ্যমে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে তিনি রাজনীতিতে ফিরে আসেন অমিত সাহসে। তবু যেন অনেকটা ছন্দ হারিয়ে ফেলেছিলেন। এরইমধ্যে ধীরে ধীরে অসুস্থতা কাবু করে ফেলে তাঁকে। তবুও অসুস্থ শরীরে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে ব্যক্ত করেছেন আত্মপ্রত্যয়ী মনোভাব আর দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার সংকট আর সম্ভাবনার কথা।সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন আজীবন রাজনীতির মাঠে আলো ছড়ানো তারকা। মাটি আর মানুষের রাজনীতি করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জননন্দিত কর্মী বান্ধব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে। হাওরের কঠিন-কোমল প্রকৃতিতে বেড়ে ওঠা একজন সুরঞ্জিত বর্ণিল রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় হয়ে উঠেছিলেন রাজনীতির কবি এবং জাতীয় নেতা।

নিজস্ব বর্ননা ভঙ্গি আর স্বভাবসুলভ উচ্চারণে তিনি ছিলেন জনপ্রিয় জননেতা । জাতীয় সংসদে, সংবাদ সম্মেলনে, রাজনৈতিক জনসভায় তিনি কথা বললে জনতা হাসতেন, কাঁদতেন, জাগতেন। আমুদে ও সদালাপী সুরঞ্জিত ছিলেন দলমতের মানুষের কাছে সমান প্রিয়। আর ভাটি বাংলার মানুষের কাছে ছিলেন আশা আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক। দেশ ও জাতির বর্তমান ক্রান্তিলগ্নে একজন সাহসী সুরঞ্জিত সেনের বড় বেশি প্রয়োজন ছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদে তিনি তাঁর প্রায় ৪০ মিনিটের বক্তব্যে, ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সংকটের কথা ব্যক্ত করেছিলেন। তাই যেন আজ বাস্তব হল। দেশের রাজনীতিতে অনেক পট পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সেই পুরনো বক্তব্যগুলো প্রাসঙ্গিক ভাবে অবিনাশী বাণী হয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির কবি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অষ্টম প্রয়াণ বার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। চিরপ্রশান্তিতে থাকুন হে সংগ্রামী জননেতা।

 

লেখক: সাংবাদিক, গবেষক ; লন্ডন, যুক্তরাজ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরও খবর

ফেসবুকে আমরা

এক ক্লিকে বিভাগের খবর

error: Content is protected !!