বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে ভাবনা
লিয়াকত হোসেন খোকন
রাজনীতি হচ্ছে কথাবার্তার ফুলঝুড়ি ছোটানোর মঞ্চ। ঠিকঠাক লাইন মতো থাকলে সব কথাই এ জগতে সঠিক। তবে এত কথার পরেও রাজনীতিতে শেষ বলে কোনও কথা নেই। কবিরা যেমন নতুন বছরের সূচনা করেন পুরোনোকে বিদায় জানিয়ে, বিশ্ব রাজনীতিতে সেই সুযোগ আর কোথায়? একটা নতুন বছর মানেই যে অতীতের সব ঝড়ঝঞ্ঝার নিঃশর্ত প্রস্থান তা কিন্তু নয়। বরং এখানে নতুন দিনের -নতুন বছরের আগমনে ভিন্নভাবে প্রস্তুতি চলে আঘাত হানার। রাজনীতির এই চিরাচরিত নীতি ভুল না হলে অতীতের তিক্ততা এ বছরও বয়ে চলবে বিশ্ব রাজনীতিতে।
বিশ্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিতে ২০২২ সাল কেমন হতে পারে এসব দ্বন্দ্বের পরিধি, উত্তেজনার পারদে কোন কোন অঞ্চল সবচেয়ে বেশি হতে পারে উত্তপ্ত? এ ক্ষেত্রে ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলের কথা বলা যায়। অন্যান্য ভৌগোলিক অঞ্চলের মতো না হলেও কৌশলগত দিক থেকে এটি বিশ্ব রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ হয়ে উঠছে ক্রমান্বয়ে। শুরুতে এটি ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কৌশলগত সহায়তার ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হলেও তা যে চীনকে ঠেকানোর প্রচেষ্টা ও প্রয়াস সেটা বলা বাহুল্য। একমেরু কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা ভেঙে চীনের ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে ওঠা অবশ্যই সাদরে মেনে নিবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা আমেরিকা। সেটাই এ অঞ্চলকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিও এ ক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি মানেই ভারত -পাকিস্তানের লড়াই, একেবারে খেলার মাঠ থেকে রাজনীতির ময়দান সবখানেই কেউ কাউকে বিন্দু পরিমাণ ছাড় দিতে নারাজ। এবার তাদের জন্য নতুন উত্তেজনা আফগানিস্তান। কাবুলে দুই পক্ষের এই প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা নতুন কিছু নয়। তবে বাস্তবতা বলে, যুদ্ধ শেষ হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না। বরং ক্ষমতায় টিকিয়ে থাকার লড়াই নতুন করে আবার যুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তালিবানেরও একই অবস্থা, রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে থাকলেও তাদের এখনও বাকি আছে আন্তর্জাতিক সমর্থন, পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞার কবলে বিপর্যস্ত অর্থনীতি একটি সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এমন পরিস্থিতিতে আফগানিস্তান কি যে কোনও এক বলয়ের দিকে নির্ভর হয়ে থাকতে পারবে, নাকি তাদের ছুটতে হবে পুরনো শত্রুর দুয়ারে? চীনের সমর্থনপুষ্ট পাকিস্তান কি এসব শুধুই তাকিয়ে দেখবে?
এর পাশাপাশি সমস্যা সঙ্কুল মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সংঘাতের এমনিতেই অন্ত নেই। আরেকটি যুদ্ধের ভার কি তারা নিতে পারবে?
সবকিছু নির্ভর করছে একটি ঘটনার ওপর, পরমাণু আলোচনার কি পরিণতি হবে ভিয়েনায়? মধ্যপ্রাচ্যে সমস্যা অনেক। কিন্তু সবকিছুর মূলে দু’একটি দেশই। তবে এসবের গোড়াপত্তন বলা যায় ইসরায়েলকে ঘিরিয়েই। ফিলিস্তিন সংকট মোকাবিলায় অতীতে ইসরায়েল বিরোধী অবস্থানে ছিল প্রায় সব আরব দেশগুলোরই। তবে সেই ধারা ভেঙে মরুভূমির দেশগুলো ছুটছে ইসরায়েলের সঙ্গে মিত্রতার দিকে। বিপরীতে দিনে দিনে আরও কঠোর অবস্থানে হাঁটছে ইরান। এখান থেকেই কি পরমাণুর উত্থান? ইরানের পরমাণু কর্মসূচি রুখতে ২০১৫ সালে চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল ইরান ও বিশ্বের ক্ষমতাশালী ৬ রাষ্ট্র। পরমাণু কর্মসূচি হতে সরে আসার ফলে ইরান আবার অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের সুযোগ পেয়েছিল। তবে পরবর্তীতে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। এর অগ্রগতি কি হবে তার ওপর ঝুলে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের আগামী দিনগুলোর পরিস্থিতি।
এ ছাড়া পূর্ব ইউরোপ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়াও নজরে থাকবে। রাশিয়ার দৃষ্টিতে পূর্ব ইউরোপ তার নিজস্ব বলয়। একই কারণে তারা এই অঞ্চলে তাদের শত্রু পক্ষের উপস্থিতিকে সব সময় সন্দেহের চোখে দেখে। ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যাবতীয় সমস্যার আদ্যোপান্তও এটি। ধারণা করা হচ্ছে, রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালাতে পারে, যেটা কারও জন্যই বৃহত্তর স্বার্থে মঙ্গলজনক হবে না। তুলনামূলকভাবে শান্ত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার আসিয়ান জোটের দেশগুলোর মধ্যে এ বছর অন্তঃর্দ্বন্দের সম্ভাবনা কম থাকলেও মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ঝামেলায় ফেলতে পারে জোটের সদস্যদের। সব মিলিয়ে আগামী দিনে বিশ্বের পরিস্থিতি কী হবে, তা বোঝা যাবে এই অঞ্চলগুলির নিত্যনতুন খবরাখবর শুনলে এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ের দিকে নজর দিলেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক; রূপনগর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
Leave a Reply