1. admin@pathagarbarta.com : admin :
মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৩২ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
বাংলাদেশ পোয়েটস ক্লাবের দুইদিনব্যাপী সাহিত্য পর্যটন মিশন মহেশখালী কক্সবাজার ৮ ও ৯ নভেম্বর নবীগঞ্জে শারদ সংকলন ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ প্রকাশিত স্বপ্নবিলাস উন্মুক্ত পাঠাগারের উদ্যোগে পাঠ প্রতিক্রিয়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত সৌম্যেন অধিকারীর কণ্ঠে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ স্মরণে প্রথম বাংলা গান মিডল্যান্ডস সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদ ইউকে সভায় বার্মিংহামে বিজয় দিবস পালনের সিদ্ধান্ত লেখা আহবান ইউকের বাংলা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভা অনুষ্ঠিত “রাষ্ট্র সংস্কারে পাঠাগারের ভূমিকা” শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত “রাষ্ট্র সংস্কারে পাঠাগারের ভূমিকা” শীর্ষক সেমিনার লন্ডনে আনন্দ ও উৎসবে দ্বাদশ বাংলাদেশ বইমেলা এবং সাহিত্য সাংস্কৃতিক উৎসব অনুষ্ঠিত

পাঠাগার ভ্রমণ ২০২২ : নেত্রকোনার পথে প্রান্তরে

পাঠাগার বার্তা
  • আপডেট সময় : বুধবার, ১০ মে, ২০২৩
  • ২২৩ বার পঠিত

পাঠাগার ভ্রমণ ২০২২ : নেত্রকোনার পথে প্রান্তরে
মোঃ জিল্লুর রহমান

সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলনের ব্যানারে গত ডিসেম্বরে টাঙ্গাইলের অর্জুনায় পাঠাগার সম্মেলন ২০২২ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সম্মেলন উপলক্ষে “পাঠাগার আন্দোলন : সঙ্কট, উত্তরণ ও সম্ভাবনা” শীর্ষক একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যক বেসরকারী গ্রন্থাগারের তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে। পাঠাগার সম্মেলন বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক আবদুস ছাত্তার খান ভাইয়ের ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে জানতে পেরে গবেষণা কাজে ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে তথ্য সংগ্রহের সুযোগ প্রদানের অনুরোধ জানাই। উদ্দেশ্য ছিল, এই সুযোগে আমাদের এলাকার পাঠাগারগুলোর কার্যক্রম আরও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং পাঠাগার উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করা। সেইসাথে নিজের দেশটাও ঘুরে দেখার একটা সুযোগ পেলে মন্দ হয়না। তো যেই ভাবা, সেই কাজ। আবদুস ছাত্তার খান ভাইয়ের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার পরই পরিকল্পনা করতে থাকি কিভাবে কম সময়ে এবং কম খরচে ময়মনসিংহ বিভাগের তথ্য সংগ্রহের কাজ সম্পন্ন করতে পারি। এরই মাঝে গবেষণা কাজের বিভিন্ন কারিগরি দিক সম্পর্কে অনলাইন প্লাটফরমে বেশ কয়েকটি প্রস্তুতিমূলক সেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরই মাঝে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে সিলেট এবং খুলনা বিভাগের তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়ে যায়। কিন্তু আমার স্নাতক ৪র্থ বর্ষের শিক্ষা সফরের কারণে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শুরু করতে পারিনি। এরপর শিক্ষা সফর থেকে ফিরে এসে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভ্রমণ পরিকল্পনা সম্পন্ন করি। প্রথমেই নেত্রকোনা জেলায় কাজ করার চিন্তা করি, কেননা ময়মনসিংহ জেলার পর নেত্রকোনাই সবচেয়ে বড় জেলা। আর, ময়মনসিংহের সবগুলো উপজেলায় আমার আগে থেকেই ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা থাকায় ময়মনসিংহকে সবার শেষে রাখি।

এরপর ছিল আবার মাস্টার্স এর ক্লাস শুরুর বিষয়টা। তবে, ৫ তারিখে জানতে পারি এই সপ্তাহে ক্লাস শুরু হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। সেদিন রাতেই ঢাকা থেকে নেত্রকোনার ট্রেনের সময়সূচি চেক করি। এবং হাওর এক্সপ্রেস এর সময়সূচিটাই আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছিল খুব। পরদিন সকালেই অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কেটে ফেলি একদম শেষ স্টপেজ মোহনগঞ্জ পর্যন্ত। রাত ১০ টা ১৫ মিনিটে ছিল ট্রেন ছাড়ার সময়। সন্ধার দিকে জাহাঙ্গীরনগর থেকে রওনা দিয়ে ঢাকায় গিয়ে ফাইজুল ইসলাম ভাইয়ের সাথে দেখা করি। ফাইজুল ভাই ময়মনসিংহের আলোর ভুবন পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা এবং বই পড়া আন্দোলন নান্দাইল এর সাধারণ সম্পাদক। নীলক্ষেতে উনার একটি বইয়ের দোকানে রয়েছে। নান্দাইল হচ্ছে নেত্রকোনার একেবারে কাছাকাছি উপজেলা। এজন্যই নেত্রকোনা এবং ময়মনসিংহের ভ্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে উনার সাথে আলোচনা করতে গিয়েছিলাম। এসময় দেখা হয়ে গিয়েছিল কুষ্টিয়ার খোকসা কমিউনিটি লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা জসিম উদ্দিন ভাইয়ের সাথে। উনার সাথেও পাঠাগার সম্মেলন এবং গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বেশকিছু বিষয় নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করে হয়েছে। এসময় ফাইজুল ভাই জাগ্রত আছিম গ্রন্থাগারের জন্য বেশকিছু বই উপহার প্রদান করেন। বইগুলো আমাদের গ্রন্থাগারের সহ-সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জাকির হাসান কাউসারের কাছে রেখে কমলাপুর চলে যাই আমি। স্টেশনে প্রবেশ করে কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করে ট্রেন ছাড়ার ১৫ মিনিট আগে আসন গ্রহণ করি। নির্দিষ্ট সময়েই শুরু হয় একটি দীর্ঘ ট্রেন যাত্রা।

ভোর ৫ টার দিকে আমাদের ট্রেন মোহনগঞ্জ পৌঁছে। মসজিদ থেকে ফজরের আযান ভেসে আসছিল তখন। স্টেশন মসজিদেই ফ্রেশ হয়ে, নামাজ পড়ে সূর্যোদয়ের পর আমার গন্তব্যের বিষয়ে চিন্তা করি। মোহনগঞ্জ পৌর ভবনের পাশেই অবস্থিত মোহনগঞ্জ সাধারণ পাঠাগার। ১৯৮৮ সাল থেকে স্থানীয় শিক্ষা, সাংস্কৃতিক কাজে নেতৃত্ব প্রদান করে আসছে এই প্রতিষ্ঠান। এই পাঠাগারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলম বিপ্লব স্যারের সাথে আগের দিন ফোনে কথা বলছিলাম। গত মাসেই জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আয়োজিত বেসরকারি গ্রন্থাগারিকদের একটি প্রশিক্ষণে উনার সাথে পরিচয় হয়েছিল। স্যার আমাদেরকে দেখা করার জন্য সকাল ৯ টায় সময় দিয়েছিলেন। কিন্তু তখন বাজে মাত্র ৬ টা। আগের পরিকল্পনা ছিল ট্রেন কিছুটা বিলম্বে পৌঁছালে এই সময়টা মোহনগঞ্জেই অপেক্ষা করব। কিন্তু সঠিক সময়ে ট্রেন পৌঁছার কারণে ৩ ঘণ্টা সময় কোন কাজ ছাড়া অপেক্ষা করতে ভালো লাগছিল না। এজন্যই পাঠাগারের পাশেই অবস্থিত সিএনজি এবং অটো স্ট্যান্ডে চলে যাই। এখানকার স্থানীয় কয়েকজনের সাথে কথা বলে পার্শ্ববর্তী উপজেলা খালিয়াজুড়ি, মদন ও আটপাড়ার দিকে যাওয়ার প্ল্যান করি। দ্রুতগতির জন্য সিএনজির ড্রাইভারের সাথে কথা বলে জানলাম, ট্রেনে আসা সকল যাত্রীরা নিজ নিজ গন্তব্যে আগেই চলে গিয়েছে। এখন সিএনজির যাত্রী ভর্তি হতে দীর্ঘসময় লেগে যাবে। এরপর অটোরিকশাতে করেই রওনা দেই খালিয়াজুড়ি উপজেলার বোয়ালি ঘাটের উদ্দেশ্যে। ধীরগতির কারণে ২২ কি.মি দূরত্বের বোয়ালি ঘাট পর্যন্ত পৌঁছাতেই ৮ টা বেজে গিয়েছে। খালিয়াজুড়ি যাওয়ার ব্যাপারে কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানলাম ট্রলারে করে খালিয়াজুড়ি যাওয়া আসায় দীর্ঘসময় লেগে যাবে। যার ফলে অন্যান্য কাজগুলো পরিকল্পনা মতো সম্পন্ন করা যাবে না। এদিকে আবার খালিয়াজুড়ির কোন পাঠাগারের ঠিকানাই আমার জানা ছিল না। এজন্যই খালিয়াজুড়ির পরিবর্তে আবার রওনা দেই পার্শ্ববর্তী মদন উপজেলার দিকে। বোয়ালি ঘাট থেকে মদন উপজেলা শহরের দূরত্ব ১২/১৩ কি.মি মাত্র।

মোহনগঞ্জ থেকে বোয়ালি ঘাট পর্যন্ত আসার পথেই ডিঙ্গাপোতা হাওর এবং রাস্তার পাশের নাম না জানা বিল ও হাওরগুলোর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য দেখেছি আমরা। সেইসাথে গ্রামের মানুষদের সকালের ব্যস্ততাও আমাদের চোখে পড়েছে। মদন যাওয়ার পথে উচিতপুরের হাওরগুলো মুগ্ধ করেছে আমাদেরকে। দর্শনার্থীদের কাছে এই হাওরগুলো উচিতপুর মিনি কক্সবাজার নামে পরিচিত। সকাল ৯ টার দিকে মদন পৌঁছে এখানেও আমরা কোন পাঠাগার খুঁজে পাইনি। তবে কাছেই আটপাড়া উপজেলার লোকগবেষক হামিদুর রহমান পাঠাগার ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক হাসান ইকবাল ভাইয়ের সাথে আগেরদিন যোগাযোগ করছিলাম আমি। এরপর নতুন পথচলা শুরু হয় এই পাঠাগারে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। এরই মধ্যে গুগল ম্যাপ থেকে আটপাড়া উপজেলার আরও দুটি পাঠাগারের সন্ধান পেয়েছিলাম। তেলিগাতী সরকারি কলেজের পাশে অবস্থিত তেলিগাতী সাধারণ পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৮৮ সালে। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন পাঠাগারের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ভেতরে ঘুরে দেখতে পারিনি। তবে, স্থানীয় কয়েকজনের সাথে কথা বলে পাঠাগার পরিচালকের মোবাইল নাম্বারটা নিয়ে আসা হইছিল। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল আটপাড়া উপজেলা পাঠাগার। দৃষ্টিনন্দন ভবন থাকলেও এই পাঠাগারটির কার্যক্রম এখন বন্ধ আছে বলে জানালেন স্থানীয় জনসাধারণ। তারপর আমরা রওনা দেই আগে থেকেই যোগাযোগ করে রাখা লোকগবেষক হামিদুর রহমান পাঠাগার ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পথে। এই পাঠাগারটির কার্যক্রম ১৯৮০ সালে শুরু হলেও নতুন ভবনে আনুষ্ঠানিক ভাবে পাঠাগারের কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবছরের জানুয়ারী থেকে। এরই মাঝে পাঠাগারটিতে বিভিন্ন বিষয়ের কয়েক হাজার বই এবং শিশুদের জন্য খেলার সামগ্রীও রয়েছে। খুবই মনোরম পরিবেশে এই পাঠাগারটির অবস্থান। স্থানীয় স্কুলের শিক্ষার্থী এবং এলাকার মুরুব্বীরা এখানে সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারেন। শিশুদের জন্য বেশ কয়েকটি ব্যতিক্রমী কার্যক্রম চোখে পড়েছে এখানে।

আটপাড়া উপজেলা থেকে আমাদের পথচলা ছিল নির্মলেন্দু গুণের স্মৃতিবিজড়িত বারহাট্টা উপজেলায়। অনলাইন প্লাটফরম থেকে নির্মলেন্দু গুণের গ্রামের বাড়িতে ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত রামসুন্দর পাঠাগার, বীণাপাণি-চারুবালা সংগ্রহশালা সহ আরও বেশকিছু কার্যক্রমের বিষয়ে জানতে পেরেছিলাম। বারহাট্টা বাজার থেকে অটোরিকশা যোগে কাশতলা গ্রামে পৌঁছি দুপুর ১ টার দিকে (নির্মলেন্দু গুণ গ্রামটির নাম দিয়েছেন কাশবন)। কিন্তু এইসময়ে পাঠাগার ও সংগ্রহশালা ছিল তালাবন্ধ। স্থানীয়রা জানান, আগে নিয়মিত খোলা থাকলেও নির্দিষ্ট গ্রন্থাগারিক না থাকাও পাঠাগারের কার্যক্রম এখন মাঝে মধ্যে পরিচালিত হয়। এরপর আবার আমরা বারহাট্টায় চলে আসি। গুগল ম্যাপ দেখে এবার চলে যাই বারহাট্টা পাবলিক লাইব্রেরিতে। ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারটি উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় এখনো ধুঁকে ধুঁকে চলতেছে। একজন গ্রন্থাগারিক সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত পাঠাগারটি খোলা রাখেন। কয়েক হাজার বই থাকলেও নতুন বইয়ের বেশ অভাব রয়েছে এখানে। পাঠকসংখ্যাও খুব কম বলে জানা গেল। এরপর আবার আমাদের পথচলা ছিল মোহনগঞ্জের দিকে। কেননা মোহনগঞ্জের পাঠাগারগুলোতে সকালে যাওয়া সম্ভব হয়নি। মোহনগঞ্জ পৌঁছে দুপুরের খাবার শেষ করে গুগল ম্যাপ দেখে আমরা চলে যাই ডাঃ আখলাকুল হোসাইন আহমেদ গ্রন্থকুঞ্জে।

মোহনগঞ্জের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং সাবেক এমপি ডাঃ আখলাকুল হোসাইন আহমেদ মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সাথেই ২০২১ সালে এই পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সপ্তাহের ৩ দিন বিকাল বেলায় এই পাঠাগারটির কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এই পাঠাগারটির প্রতিষ্ঠাতা এবং মোহনগঞ্জ সাধারণ পাঠাগারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব স্যার পাঠাগার এবং বইগুলো ঘুরে ঘুরে দেখান আমাদের। এরপর তিনি আমাদেরকে নিয়ে যান মোহনগঞ্জ সাধারণ পাঠাগারে। এই পাঠাগারটি প্রতিদিন বিকেল ৪ টা থেকে রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। পদাধিকার বলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার পাঠাগারটির সভাপতি হলেও সহ-সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হয় খুব ঝাঁকজমক পূর্ণ ভাবে। শুধু মোহনগঞ্জ নয়, পুরো নেত্রকোনা জেলায় অন্যতম ৩/৪ টি সচল পাঠাগারের মধ্যে মোহনগঞ্জ সাধারণ পাঠাগার একটি। বিস্তৃত পাঠকক্ষ, হল রুম এবং আলাদা অফিস রুম রয়েছে পাঠাগারটির। নিয়মিত পাঠাগার খোলা রাখার জন্য এবং সবকিছু রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য বেতনভুক্ত গ্রন্থাগারিক এবং একজন কর্মচারী রয়েছে এখানে। ম্যাগাজিন প্রকাশনা সহ বিভিন্ন কার্যক্রমে সারাবছরই সচল থাকে পাঠাগারের কার্যক্রম। সেইসাথে রয়েছে অসংখ্য বইয়ের সংগ্রহ। মোহনগঞ্জ সাধারণ পাঠাগার ঘুরে দেখার পর আমরা রওনা দেই নেত্রকোনার উদ্দেশ্যে। সন্ধা হয়ে যাওয়ায় এদিন আর কোন পাঠাগার পরিদর্শন করা সম্ভব হয়নি।

নেত্রকোনা সরকারি কলেজের ছাত্র পরিচিত এক ছোট ভাইয়ের বাসায় রাত্রিযাপনের পর পরদিন ভোরে আবার বের হই কলমাকান্দা, দুর্গাপুরের দিকে। এর আগে দেখা করি আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, নেত্রকোনার সহকারী শিক্ষক সারোয়ার আলম জিয়া ভাইয়ের সাথে। জিয়া ভাই আমাদের জাগ্রত আছিম গ্রন্থাগারের একজন শুভাকাঙ্খী। আগেরদিন উনার সাথে কথা বলে সময় নেওয়া ছিল। পাঠাগার সম্মেলন এবং আমাদের গবেষণা কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয় তখন। এরপর সময় স্বল্পতার কথা বিবেচনা করে মোটরসাইকেলে আমরা যাই কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরপুরে। কিন্তু এখানে কোন পাঠাগার খুঁজে পাইনি। আগেরদিন হাসান ইকবাল ভাইয়ের কাছ থেকে নেত্রকোনা জেলার সরকার নিবন্ধিত পাঠাগারগুলোর একটি তালিকা পেয়েছিলাম। সেই তালিকায় কলমাকান্দার একটিমাত্র পাঠাগারের নাম ছিল। অনলাইনে সার্চ দিয়ে এই পাঠাগারের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ দেখে এখানে আর যাওয়া হয়নি। এরপর বাসে করে রওনা দেই সোমেশ্বরীর তীরে দুর্গাপুর উপজেলার পথ পাঠাগারের অস্থায়ী কার্যালয়ের উদ্দেশ্যে। দুর্গাপুর পৌঁছে টঙ্ক শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ ও কমরেড মণি সিংহ স্মৃতি জাদুঘর ঘুরে দেখে আমরা যাই পথ পাঠাগারের কার্যালয়ে। পাঠাগারটির প্রতিষ্ঠাতা নাজমুল হুদা সারোয়ার ভাইয়ের সাথে আগেই আমার কথা হয়েছিল। উনার নির্দেশনা অনুযায়ী পথ পাঠাগারের কার্যালয়ে গিয়ে দেখি একটি ফটোকপি ও অনলাইন সার্ভিস প্রদানকারী দোকানের একপাশে এর অবস্থান। দোকানটির পরিচালকও নাজমুল হুদা সারোয়ার ভাই নিজেই। কাজের সুবিধার্থে দুটি প্রতিষ্ঠানকেই একসাথে নিয়ে এসেছেন উনি। ২০২০ সালে ২০ টি বই নিয়ে কাজ শুরু করে নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন স্থানে এখন উনি ১৪ টির বেশি শাখা স্থাপন করেছেন। তবে, পথ পাঠাগারের জারিয়া ঝাঞ্জাইল রেলওয়ে স্টেশন শাখা পরিদর্শন করে আমার খুব একটা সুখকর অভিজ্ঞতা হয়নি। যথেষ্ট সময় নিয়ে অন্যান্য শাখাগুলোও ঘুরে দেখে এর কার্যকারিতা সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে হয়ত।

সোমেশ্বরী নদী পেরিয়ে এবার আমাদের পথচলা ছিল বিরিশিরির জলসিঁড়ি পাঠকেন্দ্র। সোমেশ্বরী নদীর ব্রিজের সাথেই একটি সেলুনে স্থাপিত হয়েছে জলসিঁড়ি পাঠকেন্দ্রের ২য় শাখা। প্রায় ২ শতাধিক বই রয়েছে এই সেলুন পাঠাগারটিতে। পাঠাগারটিতে প্রবেশের পূর্বেই আমরা দেখতে পাই একজন পত্রিকা পড়ছেন চেয়ারে বসে। বেশ কিছু বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে টেবিলের উপর। শুধুই যে সাজিয়ে রাখার জন্য নয় বইগুলো, সেটাই বুঝতে পারলাম এতে। এখান থেকে ৫ কি.মি দূরে গাভিনা গ্রামে অবস্থিত জলসিঁড়ি পাঠকেন্দ্রের প্রধান শাখা। নিজস্ব দুটি ভবনে খুবই সাজানো গোছানো ভাবে পাঠাগারটির কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আগেরদিন ফোনে কথা হয়েছিল পাঠাগারটির প্রতিষ্ঠাতা দীপক সরকার ভাইয়ের সাথে। উনি ময়মনসিংহের একটি কলেজে শিক্ষকতা করায় স্থানীয় একজন ব্যক্তি গ্রন্থাগারের দায়িত্বে আছেন এখন। তিনিই আমাদেরকে সবকিছু ঘুরিয়ে দেখালেন এবং জলসিঁড়ির কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। এদিন সন্ধার পর আবার দীপক ভাইয়ের সাথে নেত্রকোনা শহরে সরাসরি দেখা করেছিলাম। তখন আরও বিস্তারিত ভাবে নেত্রকোনার শিল্প, সাহিত্য ও বেসরকারি গ্রন্থাগার গুলোর অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারছি। দীপক সরকার ভাই ২০১২ সালে জলসিঁড়ি পাঠকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার আরও ১০ বছর আগে থেকেই জলসিঁড়ি অধ্যয়নসভার মাধ্যমে বিভিন্ন সৃজনশীল কাজ করে আসছেন। জলসিঁড়ি পাঠকেন্দ্র থেকে আমরা যাই জারিয়া ঝাঞ্জাইল স্টেশনে। সেখানে পথ পাঠাগারের শাখা পরিদর্শনের পরই দেখি ময়মনসিংহগামী লোকাল ট্রেন ছাড়ার সময় এখন।

জারিয়া ঝাঞ্জাইল থেকে ২৩ কি.মি দূরবর্তী শ্যামগঞ্জ এর টিকিটের মূল্য মাত্র ১০ টাকা। অথচ এই ১০ টাকার টিকিট কাটতেই সকলের মাঝে কত যে অনীহা দেখলাম। আমরা শ্যামগঞ্জ এসে পৌঁছলাম দুপুর আড়াইটার দিকে। আগে থেকেই যোগাযোগ করে রাখায় পূর্বধলার শাহেদা স্মৃতি পাঠাগারের গ্রন্থাগারিক লেনিন খান পাঠান ভাই অপেক্ষা করছিলেন শ্যামগঞ্জ রাজারেই। উনার সাথে রওনা দেই বীর উত্তম কর্নেল তাহেরের স্মৃতি বিজরিত কাজলা গ্রামের দিকে। ক্রাচের কর্নেল পড়ে কর্নেল তাহের এবং উনার গ্রামের বাড়ী সম্পর্কে আলাদা একটা আবেগ কাজ করছিল। শাহেদা স্মৃতি পাঠাগারটি কর্নেল তাহেরের বাড়ী এবং কবরস্থানের পাশেই অবস্থিত। কাজলা বাজারের অল্প একটু দূরে একদম পাকা রাস্তার পাশেই নিজস্ব জায়গায় দৃষ্টিনন্দন পাঠাগার ভবন। বেশ কয়েক হাজার বইয়ের পাশাপাশি এখানে রয়েছে নিরিবিলিতে বসে সারাদিন বই পড়ার ব্যবস্থা। একসাথে ৩০/৪০ জন পাঠক এখানে বই পড়তে পারেন। রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ম্যাগাজিনের একটি বিশাল সংগ্রহ। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার আনসার উদ্দিন খান পাঠান উনার মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত এই পাঠাগারে কোন কিছুর কমতি রাখেন নি। গ্রামের মহিলারা থেকে শুরু করে শিশু, কিশোর এবং বৃদ্ধরাও এখানে নিয়মিত বই পড়তে আসেন। সেইসাথে গ্রন্থাগারিক লেনিন খান পাঠান ভাইয়ের দরদ মাখানো পরিচর্যায় পাঠাগারটি জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে সর্বত্র। এখান থেকে আমরা আবার চলে যাই নেত্রকোনা শহরে। গুগল ম্যাপ দেখে নেত্রকোনা শহরের দুটি পাঠাগারের খোঁজ করলেও আমরা সফল হইনি। পরবর্তীতে দীপক ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ শেষে ময়মনসিংহের দিকে রওনা দেই আমরা। এবং সুস্থভাবেই ঘরের ছেলে ঘরে পৌঁছেছি, আলহামদুলিল্লাহ।

এই ২ দিনের পথচলায় আমরা নেত্রকোনার ৯ টি উপজেলায় গিয়েছিলাম। শুধুমাত্র কেন্দুয়া উপজেলায় আমাদের কাজ করা বাকী ছিল। পরবর্তীতে ময়মনসিংহ জেলায় ভ্রমণের সময় গৌরিপুর থেকে আমরা যাই কেন্দুয়ার দলপা ইউনিয়নের বেখৈরহাটি বাজারে অবস্থিত অন্বেষা পাঠাগারে। অন্বেষা পাঠাগারটি ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত। কয়েক হাজার বই রয়েছে এখানে। তবে অধিকাংশই অনেক পুরনো বই। আমরা যখন পাঠাগারটি পরিদর্শন করি তখন দেখি একজন বাঁধাই কর্মী পাঠাগারের পুরাতন বই বাঁধাইয়ের কাজ করছেন। উনি জানালেন ৪০০ বই বাঁধাই এর কাজ দেওয়া হয়েছে উনাকে। স্থানীয় একজন স্কুলছাত্রের কাছ থেকে জানতে পারি জীর্ণশীর্ণ এই টিনের ঘরটি থেকে অন্য জায়গায় পাঠাগারটি স্থানান্তর করার কাজ চলছে। পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে এনে আবারও সগৌরবে পরিচালিত হবে বেসরকারী গ্রন্থাগারগুলো। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর হিসেবে কাজ করবে এসব পাঠাগার। এমনটাই প্রত্যাশা আমাদের।

লেখক : পরিচালক, জাগ্রত আছিম গ্রন্থাগার, আছিম বাজার, ফুলবাড়ীয়া, ময়মনসিংহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরও খবর

ফেসবুকে আমরা

এক ক্লিকে বিভাগের খবর

error: Content is protected !!