সুকুমার দাস : সময়ের সাহসী সন্তান
রত্নদীপ দাস (রাজু)
সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা ও গভীর ভালবাসায় সিক্ত হয়ে পরপারের পথে যাত্রা করলেন নবীগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রভাবশালী ও সর্বমহলে সাহসী নেতা হিসেবে খ্যাত এবং কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা সুকুমার দাস। বিগত ১৮ নভেম্বর ২০১২ খ্রিস্টাব্দের রোজ রবিবার সকাল ১০ ঘটিকায় নবীগঞ্জের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে তাঁর মরদেহে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ শেষ শ্রদ্ধা জানায়। নবীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে তাঁকে বিউগলের করুন সুরে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার পর তাঁর নিজ গ্রামের বাড়ি গুমগুমিয়ায় অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
কীর্ত্তিমান এই পুরুষ ১৯৪৯ সালের ১৫ নভেম্বর নবীগঞ্জ উপজেলার গুমগুমিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম স্বর্গীয় সনৎ কুমার দাস ও মাতা অনামিকা দাস। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি জ্যৈষ্ঠ। তিনি ১৯৬৬ সালে নবীগঞ্জ জে,কে উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক্যুলেশন পাশ করেন। বাবার মৃত্যুর কারণে এক বছর শিক্ষাবিরতীর পর ১৯৬৯ সালে হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও একই কলেজ থেকে ১৯৭২ সালে বি,কম পাশ করেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন হবিগঞ্জ মহকুমার সক্রিয় ও নীতিনির্ধারনী পর্যায়ের নেতা ছিলেন।
১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে তিনি স্বসস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সম্মুখ সমরে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বহুবার পাক সেনা নিধনযজ্ঞে কৃতিত্ত্ব দেখান। যার জন্য তাঁকে কয়েক বার গুরুতর আহত হতে হয়েছিল। সুকুমার দাস ও তাঁর সহযোদ্ধা সুরঞ্জন দাস (পরে মেজর) ক্যাম্প থেকে পাক সেনাদের ইনফরমারদের ধরে এনেছিলেন। তিনি ৫ নম্বর সেক্টরের চেলা সাব-সেক্টরে কেপ্টেন হেলাল (পরে কর্নেল) এর অধীনে যুদ্ধ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সিলেট অঞ্চলের ৪ নং ও ৫ নং সেক্টর থেকে যদি ৪/৫ জন মুক্তিযুদ্ধার নাম আসে তাহলে সর্বাগ্রে সুরঞ্জন দাস ও সুকুমার দাস’র নাম আসবে। মেজর (অবঃ) সুরঞ্জন দাসের সাথে আলাপচারিতায় জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৪ অক্টোবর স্বাধীন বাংলাবেতার কেন্দ্র থেকে যখন বার বার প্রচারিত হয়েছিল ছাতকের সিমেন্ট ফেক্টরীর সংলগ্ন নোয়ারাই নামক স্থানে বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুই কোম্পানী মুক্তিবাহিনী সহ কেপ্টেন আনোয়ার ও কেপ্টেন আকবর হোসেন (পরে কর্নেল ও মন্ত্রী) পাক সেনাদের কবলে পড়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। তখন সুকুমার দাস ও সুরঞ্জন দাস জীবনের ঝুকি নিয়ে অগ্রনী ভূমিকা রেখে পাক সেনাদের কবল থেকে তাঁদের রক্ষা করেছিলেন। শতশত রাজাকার ও পাক সেনাদেরও সেদিন তাঁরা ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। এক সময় চেলা সাব-সেক্টরে সুকুমার দাস ও সুরঞ্জন দাস প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
দেশ স্বাধীনের পর নবীগঞ্জের তৎকালীন ডাক বাংলোর মাঠে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ প্রয়াত কমরেড প্রসূন কান্তি রায় (বরুন রায়) ও মরহুম পীর হাবিবুর রহমান এক জনসভায় বক্তব্য দানকালে বলেছিলেন, ‘নবীগঞ্জের দুই কৃতি সন্তান সুরঞ্জন ও সুকুমার মুক্তিসমরে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে তুখোর যুদ্ধ করেছে এবং আমাদেরকে পাক বাহিনীর আক্রমণ থেকে করেছে রক্ষা। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য সরকার তাঁদের বীরত্ত্ব ভূষন খেতাবে ভূষিত করবে।’
সিলেট রেজিস্টার মাঠে এক জনসভায় মুক্তিযুদ্ধের সাব সেক্টর কমান্ডার সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (বর্তমানে মন্ত্রী) ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মরহুম আবদুস সামাদ আজাদ (প্রাক্তন মন্ত্রী) একই কথা বলেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্ত্ব গাঁথা যুদ্ধ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলার মাটি যতদিন থাকবে তাঁর নাম ততদিন চির অম্লান হয়ে থাকবে।
তিনি ১৯৮৫ সালে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা নমিতা দাসের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পারিবারিক বন্ধন টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনেও ছিলেন সোচ্ছার। তিনি নবীগঞ্জ উপজেলার ৭ নম্বর করগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে ১৯৮৩, ১৯৯২,১৯৯৭ ও ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে বিপুল ভোটে জয়ী হন এবং সর্বশেষ ২০০৯ খ্রি. নবীগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাঁর মৃত্যুতে নবীগঞ্জে নেতৃত্বের যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণ হওয়ার নয়। নবীগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি ছিলেন এক অপরিহার্য নেতা। একদিন তাঁর সাথে নবীগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে (তখন উপস্থিত ছিলেন- উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার রবীন্দ্রনাথ দাশ সহ আরও কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা) আলাপচারিতা কালে নবীগঞ্জের সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি পুরুষ শ্যামাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত (বিধুবাবু)’র প্রসঙ্গঁ উঠলে তিনি কৌতুক ছলে বলেন, “তিনি (বিধুবাবু) আমাকে Good bachelor বলতেন। Good অর্থ ভাল, মানে সু, আর bachelor অর্থ অবিবাহিত, মানে কুমার, সে হিসেবে Good bachelor অর্থ দাঁড়ায় সু-কুমার।”
নবীগঞ্জে তিনি ছিলেন অভিবাবক স্বরূপ। আমার মনে হয় তিনি ধীর, স্থির ও উপস্থিত বুদ্ধি সম্পন্ন একজন জনপ্রতিনিধি ও নেতা। যে কোন তীব্র সংকট পূর্ণ পরিবেশকেও তিনি নিয়ন্ত্রনে আনাতে পারতেন অতি সহজে। প্রতিকূল পরিবেশেও যে কোন কঠিন সিদ্ধান্ত দেওয়ার মত সৎসাহসী ছিলেন। যার জন্য নবীগঞ্জ ছাড়াও বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ, বাহুবল, শাল্লা, দিরাই, জগন্নাথপুর উপজেলা সহ বিভিন্ন উপজেলায় গুরুত্বপূর্ণ পঞ্চায়েত সালিশে তাঁর পদার্পন ছিল। তিনি ছিলেন সময়ের সাহসী সৈনিক। ২০১২ সালের ১৩ নভেম্বর রাত ৮ ঘটিকায় হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ৬৯ বছর বয়সে ইহলোক ছেড়ে পরলোকে গমণ করেন এই মেধাবী ও প্রজ্ঞাবান নেতা।
মানুষ চলে যায়, কিন্তু তাঁর কর্ম অন্যের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। সুকুমার দাস ছিলেন তেমনি এক গুণী ব্যাক্তি, যাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও সাহসীকতা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উদ্দীপ্ত করবে। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মে, আদর্শে সমুজ্জ্বল হয়ে। মৃত্যুকালে তিনি মা, স্ত্রী, কন্যা, ভাই, বোনসহ অসংখ্যক গুনাগ্রাহী রেখে গেছেন। আমি তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এবং তাঁর আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক; সম্পাদক ও প্রকাশক, পাঠাগার বার্তা।
বিদ্র. উক্ত নিবন্ধ বাবু সুকুমার দাসের মৃত্যুর পরপর ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে লেখা।
Leave a Reply