পুতুল নাচের ইতিকথার ইতি?
লিয়াকত হোসেন খোকন
পৌষ চলে গেছে – এই মাঘ মাসে জেঁকে বসেছে শীত। অথচ এই শীতকালীন সময়ে পুতুল নাচের দল আসে না শহর, নগর আর গ্রামে। একসময় দলে দলে পুতুল নাচের দল
আসত গ্রামেগঞ্জে আর শহরে। পুতুল নাচ দেখার জন্য দলে দলে জনতা ভিড় করত। পুতুল নাচ দেখার জন্য মেঠোপথ পেরিয়ে কৃষি মেলায় যেতাম আর সেখানে এককোনায় আলাদা জায়গায় দেখানো হতো পুতুল নাচ। সেই কবে পুতুল নাচ দেখতে দেখতে একটি ডায়লগ আজও মন থেকে মুছে গেল না ,
আর তা হল – ” সোনাইকে আমার চাই “। সোনাই দিঘি পালার সেই বিখ্যাত ডায়লগ আর শোনা যাবে না। কারণ পুতুল নাচের দল তো আর আসে না। পুতুল নাচ দেখে ফিরে আসতাম প্রিয় বন্ধু সজল এতবারের হাত ধরে।
আজও মনে পড়ে পুতুল নাচ দেখা শেষ করে জনতা
গুণগুণ করে গাইত, ” আর আসে না রাজার কুমার পক্ষীরাজে চড়ে। ” যুগ পাল্টেছে, তাই পুতুল নাচের দল আর দেখা যায় না। আজও মনে পড়ে, হাতে বা সুতোয় পুতুলদের নাচিয়ে ফুটিয়ে তোলা হত কোনও আখ্যান। নাচের পুতুল প্রধানত চার ধরনের – ডাং বা কাঠ পুতুল ; সুতো বা তারের পুতুল ; দস্তানা বা হাতমোজার পুতুল এবং ছায়া পুতুল। তবে চল ছিল দুই ধরনের –
টুষাডিশনাল পুতুল ও ফ্যাশনেবল পুতুল। সম্রাট অশোকের আমল থেকেই পুতুল নাচের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেটা কাঠপুতলি বা ডাং পুতুল। মধ্যযুগে পাঞ্চালিকা দলের হাতেই সম্ভবত সুতোয় টানা পুতুল নাচের উৎপত্তি। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার তিতাস নদী তীরের কৃষ্ণনগরের বিপিন পাল নামক এক ব্যক্তি পুতুল নাচকে জনপ্রিয় করেন। বিপিন পাল তৎসময়ে সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বন করে পুতুল নাচ করতেন। পুতুল নাচ জনপ্রিয় করার পিছনে অবদান রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আরও কয়েকজনার। তারা হলেন গিরিশ আচার্য, তারু মিঞা, রাজা হোসেন, ধন মিঞা প্রমুখ। ধন মিঞার পুতুল নাচ দলের নাম ছিল রয়েল বীনা অপেরা। পুতুল নাচ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জনপদের এক ঐতিহ্য – কিন্তু তা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। শুধু কি তাই, বাঙালি সাহিত্যিক মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা উপন্যাসের কথা এ প্রজন্মের কাছে অজানা হয়ে থেকে গেল। তবে পুতুল নাচের ইতিকথা উপন্যাসের কাহিনী পুতুল নাচ নিয়ে নয়। পুতুল নাচের ইতিকথায় মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমাজতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় মেলে। ডাং পুতুলের চল ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে, তবে বেশি জনপ্রিয় ছিল হাওড়ার শ্যামপুরে। শ্যামপুর গ্রামের শীতলা মাতা থিয়েটার ; নস্করপুর গ্রামের বিশালাক্ষী পুতুল থিয়েটার ; আন্টিলাপাড়ার মা মনসা থিয়েটার ; জামিরা গ্রামের যামিনী বাবুর দল ; সৈয়দপুর গ্রামের ভাগ্যলক্ষ্মী থিয়েটার ; গড়চুমুক ও মহবতপুরের লক্ষ্মীনারায়ণ থিয়েটার এবং মা জয়চন্ডী অপেরা ছিল বেশ জনপ্রিয়। এই সমস্ত পুতুল নাচের দল বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় এমনকী বিদেশেও পুতুল নাচ দেখিয়ে সুনাম অর্জন করেছিল সেই ১৯৬০ এর দশকেও। যা আজও চোখের পাতায় জ্বলজ্বল করে ভাসছে। শীতকাল জুড়ে গ্রামে গ্রামে চলত পুতুল নাচের প্রদর্শনী। আমাদের গ্রামের মাঠে মেলায় চট ঘিরে, ডে -লাইট জ্বেলে প্রদর্শন হত পুতুল নাচ। খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল – সোনাই দিঘি, নাচ মহল, সীতা, হরিশ্চন্দ্র, মহিষাসুর বধ ইত্যাদি পালা। কত বয়স্ক ব্যক্তি চাদরমুড়ি দিয়ে বসে সেইসব পালা দেখতেন – আহা সেই সব পালা দেখার মজাই ছিল আলাদা। দক্ষ শিল্পীদের একই গলায় পুরুষ ও মহিলার কথা ও গান আজও মনে গেঁথে আছে। ডে -লাইটের পরে আসে বিদ্যুৎ – বিদ্যুতের আলোতেও চলে পুতুল নাচের পালা। পরে পুতুলকে ব্যবহার করে এই সমস্ত লোকশিল্পীদের কাজে লাগানো হয়, নানা সামাজিক ও সচেতনতা প্রচারে।
আজও মনে গেঁথে আছে অনেক স্মৃতি। যেমন পুতুল নাচ কোথায় কোথায় জনপ্রিয়, তা নিয়ে হত বেশ আলোচনা হতো আমাদের স্কুলে। একবার ক্লাস টিচারের মুখে শুনেছিলাম, আজ সন্ধ্যায় পুতুল নাচ আছে দক্ষিণ পাড়ার মাঠে – সেখানে তারের পুতুল নাচ প্রদর্শনী হবে। সেই সময়ে তারের পুতুল বেশি দেখা যেত যশোর, খুলনা, নদীয়া, মেদিনীপুর, বরিশাল, ফরিদপুর, হাওড়ায়। শীত এলে মনে পড়ত নলেন গুড় ও নানা পিঠের কথা। পিকনিক ও মেলার কথা। আরও মনে পড়ত পুতুল নাচের কথা – পুতুল নাচ বাংলা সংস্কৃতির এক প্রাচীন বিনোদন। গ্রামীণ জনপদে আবালবৃদ্ধবনিতার বিনোদনে বিশেষ করে শিশুদের বিনোদনে পুতুল নাচ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেই জনপ্রিয় লোকশিল্প পুতুল নাচ এখন আর দেখা যায় না। তবে কি পুতুল নাচের ইতিকথার ইতি?
লেখক : প্রাবন্ধিক; রূপনগর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
Leave a Reply