হারিয়ে যাচ্ছে চিরচেনা পাখি
লিয়াকত হোসেন খোকন
হারিয়ে যাচ্ছে চিরচেনা পাখি – জবাব দেওয়ার কেউ নাই। এই তো সেদিনও দেখেছি গাছের ডালে পাখির কূজনে সবসময় মাতোয়ারা থাকত আমার জন্মস্থান পিরোজপুরের প্রকৃতি – গ্রামবাংলা ছিল সারাক্ষণ পাখির কলরবমূখর। কোথায় গেল সেদিন! পাখির সুমধুর ডাকে বাংলার লোকের ঘুম ভাঙলেও, গ্রামবাংলার গ্রামগঞ্জে আগের মতো আর পাখির ডাক শোনা যায় না। কালের আবর্তে বাংলাদেশের প্রকৃতি থেকে ধীরে ধীরে নানা রঙের -নানা প্রজাতির বৈচিত্র্যময় পাখি হারিয়ে যাচ্ছে। জলাভূমি, বিল, শাখানদী বা খাল ভরাট করা হচ্ছে বা ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে লোকালয় থেকে পাখিরা হারিয়ে যাচ্ছে। একসময়ের আজকে ভরাট হয়ে যাওয়া সেইসব জলাভূমি থেকে খাবার জোগাড় করে পাখিরা বেঁচে থাকত। সেইসব জলাভূমি না থাকার কারণে পাখিও চোখে পড়ে না। এছাড়াও নানা কারণে -অকারণে সব বড়ো বড়ো গাছকে কেটে ফেলা হচ্ছে। এইসব গাছ পাখিদের নিরাপদ আবাসস্থল হিসাবে কাজ করত। পাখির আবাসস্থল নির্বিচারে ধ্বংস আর নানা ফসলের ক্ষেতে কীটনাশক ছড়ানো আর মোবাইলের নেটওয়ার্কের প্রভাবে অনেক পাখি আজ লুপ্তপ্রায়। বিশেষকরে দোয়েল, ঘুঘু, মাছরাঙা, ডাহুক, টুনটুনি, শালিক, বাবুই, কোকিল, কাঠঠোকরা, প্যাঁচা, চিল, বউ কথা কও -সহ আরো অনেক পাখি আর সচরাচর দেখা যায় না। এসব পাখির মধুর ডাক শোনা যায় না। তাদের আর উড়তেও দেখা যায় না।
আজকের সময়ের অনেক ছেলেমেয়েরা এইসব পাখি হয়তো চোখেই দেখেনি। অনেকেই এসব পাখির নামও জানে না। শুধু পড়ার বইয়ের ছবিতেই দেখেছে। ফলে তরুণ প্রজন্মের কাছে এইসব পাখি হয়ে যাচ্ছে গল্প আর ইতিহাস। এই প্রজন্মের অনেক শিশু -কিশোর কখনো মুক্ত আকাশে উড়ন্ত এইসব নামকরা পাখি দেখেনি – শোনেনি এইসব পাখির ডাক। বাংলাদেশের শত শত প্রজাতির ঐতিহ্যবাহী পাখি এভাবে মানুষের অজান্তেই হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের স্থানীয় পাখি ছাড়াও শীতের সময়ে সুদূর সাইবেরিয়া ও মঙ্গোলিয়ার মতো হাজার হাজার মাইল দূরের দেশ থেকে নানা ধরনের ছোটো -বড়ো পরিযায়ী পাখির দল আসে। এইসব পাখির কলকাকলিতে চারিদিক মুখর হয়ে থাকে। এরা সাধারণত জলাভূমি, বিল, পুকুর ও নদীতীরে আশ্রয় নেয়। পঞ্চগড় জেলার বিভিন্ন স্থানে, নীলফামারীর নীলসাগর তীরে, চরাঞ্চলে -সহ নানা জায়গায় ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আসে। এদের উপস্থিতিতে এসব জায়গার সৌন্দর্য কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
দিনাজপুরের রামসাগর তীরে কিম্বা নীলসাগরের তীরে কৌতুহলী লোকরা ভিড় জমান এদের দেখতে। কিছু অসাধু চক্র এইসব পাখি অবৈধভাবে শিকার করে খায়, মেরে এর মাংস বিক্রি করে বা ধরে বন্দী করে বিক্রি করে। সামান্য লাভের জন্য আমাদের বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের বিপুল ক্ষতি হচ্ছে। অনেক জলাশয়ের পাশে পিকনিক স্পটে লোকজন সাউন্ডবক্স বাজিয়ে হৈ হুল্লোড় করার ফলেও পাখিরা বিরক্ত হয়ে সেখানে আর থাকতে পারে না। পাখি বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে পাখি নিধনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। অসাধু লোকদের হাত থেকে জীববৈচিত্র্যকে রক্ষার জন্য প্রশাসনের পদক্ষেপের সঙ্গে সব ধরনের মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। মানুষের যদি বাঁচার অধিকার থাকতে পারে, তবে পাখিদের বাঁচার অধিকার থাকবে না কেন? পাখি রক্ষার জন্য সরকারি দপ্তরের তো অভাব নেই। আছে পরিবেশ মন্ত্রণালয় আর প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়। আর এই সবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে বিভিন্ন দপ্তর। তারপরেও পাখি কেন যায় হারিয়ে?
লেখক : প্রাবন্ধিক ; রূপনগর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
Leave a Reply