রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন, স্ত্রী জাতির অবনতি এবং আজকের সমাজে নারীর অবস্থান
গীতশ্রী সাহা
নতুন বছর আসছে। কিছু দিন আগে আমরা পেরিয়ে এসেছি ৯ই ডিসেম্বর ২০২১। দিনটা সবার কাছে বিশেষ করে আমাদের নারী জাতির কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই তারিখে এমন একজন ব্যক্তিত্বময়ী নারীর আবির্ভাব ঘটেছিল যা বাংলা তথা বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করে। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নারী শিক্ষার যে প্রদীপ শিখা জ্বালিয়ে ছিলেন, সেই শিখার আলোকে আলোকিত হয়ে যিনি নারী জাতিকে পথ দেখানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছেন তিনি হলেন রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন (জন্ম ৯ ডিসেম্বর ১৮৮০ – মৃত্যু ৯ ডিসেম্বর ১৯৩২) । আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি, সেই সময় তাঁর লেখা একটি প্রবন্ধের মাধ্যমে প্রথম পরিচয় হয় তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। প্রবন্ধটি “স্ত্রী জাতির অবনতি” । প্রবন্ধটি পড়বার সময় রক্তের শিরায় শিরায় একটা উদ্দীপনা অনুভব করতাম। সেই যুগে দাঁড়িয়ে একটি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করে তিনি যেভাবে নারীদের পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব পালন করেছিলেন তা এক কথায় শ্রদ্ধা ও প্রশংসার দাবী রাখে। তিনি লিখেছেন “আমাদের শয়নকক্ষে যেমন সূর্য্যালোক প্রবেশ করে না, তদ্রূপ মনোকক্ষেও জ্ঞানের আলোক প্রবেশ করিতে পায় না।“ আরোও বলেছেন
আমরা আলস্যের,-প্রকারান্তরে পুরুষের-দাসী হইয়াছি। ক্রমশঃ আমাদের মন পর্যন্ত দাস (enslaved) হইয়া গিয়াছে। এবং আমরা বহু কাল হইতে দাসীপনা করিতে করিতে দাসত্বে অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি। এইরূপে আমাদের স্বাবলম্বন, সাহস প্রভৃতি মানসিক উচ্চবৃত্তিগুলি অনুশীলন অভাবে বারবার অঙ্কুরে বিনাশ হওয়ায় এখন আর বোধ হয় অঙ্কুরিতও হয় না। কাজেই পুরুষজাতি বলিতে সুবিধা পাইয়াছেন”
একদিকে তিনি যেমন ছিলেন চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক অন্যদিকে ছিলেন সমাজ সংস্কারক। এক কথায় বলা যায় তিনি ছিলেন বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের পথিকৃৎ। ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, প্রতিটা ক্ষেত্রেই তাঁর কলমে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে গেছেন। যুক্তিনিষ্ঠ তথ্য ছিল তার সৃষ্টির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি চেয়েছিলেন নারীরা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে স্বাবলম্বী হয়ে উঠুক ও সমান অধিকার অর্জন করুক। নারীদের সামাজিক বঞ্চনার দিক এবং ধর্মের আবরণে নারীদের কিভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখা হয়েছে তা খুব পরিষ্কার ভাবে পাওয়া যায় তার রচনায়।
তিনি লিখেছেন— “যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। আমরা প্রথমত যাহা মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি। আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।”
নারীর দুর্বল দিক ও তার কারণগুলো তাঁর রচনায় পরিচ্ছন্ন ভাবে তুলে ধরেছেন এবং এর থেকে নিস্কৃতির পথও নির্দেশ করতে চেয়েছেন তিনি। তিনি লিখেছেন—
“বিপদসংকুল সংসার হইতে সর্বদা সুরক্ষিতা আছি বলিয়া আমরা সাহস, ভরসা, বল একেবারে হারাইয়াছি। আত্মনির্ভরতা ছাড়িয়া স্বামীদের নিতান্ত মুখাপেক্ষী হইয়া পড়িয়াছি। সামান্য হইতে সামান্যতর বিপদে পড়িলে আমরা গৃহকোণে লুকাইয়া গগনভেদী আর্তনাদে রোদন করিয়া থাকি! ভ্রাতৃমহোদয়গণ আবার আমাদের নাকি কান্নার কথা তুলিয়া কেমন বিদ্রূপ করেন তাহা কে না জানে? আর সে বিদ্রূপ আমরা নীরবে সহ্য করি। আমরা কেমন শোচনীয়রূপে ভীরু হইয়া পড়িয়াছি, তাহা ভাবিলে ঘৃণায়-লজ্জায় মৃতপ্রায় হই।”
তিনি আজীবন সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করে গেছেন, শিক্ষা আর পছন্দ অনুযায়ী পেশা নির্বাচনের মাধ্যমেই যে নারী মুক্তি আসা সম্ভব একথা তিনি বারবার বলেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই সমাজে নারী তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে ও সামাজিক বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হবে। ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে উঠে তিনি নারীকে তার স্ব-মহিমায় বিকশিত হবার শক্তি জুগিয়েছিলেন। এই কারণে নারীশিক্ষার প্রসার এবং নারীদের দুর্দশা দূর করতে হাতে-কলমে কাজও করে গেছেন তিনি।
রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন সাম্যে বিশ্বাসী ছিলেন।
তিনি কখনোই পুরুষকে ছোট করে দেখেননি। তিনি লিখেছেন—
“আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ, আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কীরূপ? কোনো ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা আমাদের লক্ষ্য তাহাই।”
রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেনের এই আহ্বানের পর পার হয়ে গেছে এক শতাব্দীর বেশি সময়। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ প্রাবন্ধিক রোকেয়ার আহ্বানে কতটা সাড়া দিয়েছেন সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। আমাদের সমাজ শিক্ষা তথা সার্বিক উন্নয়নের পথে পা বাড়িয়ে পুরোপুরি এগিয়ে এসেছে কি আদৌও? মেয়েদের বেশি লেখাপড়া না শেখানো, অল্পবয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া, লেখাপড়া জানা মেয়েদেরও ঘরসংসারের দায়িত্ব পালনের কথা বলে চাকরিবাকরি করতে না দেওয়া ইত্যাদি ঘটনা হামেশাই ঘটে চলেছে এবং যার জ্বলন্ত উদাহরণ ২০২০ ও ২০২১। বহু স্কুল পড়ুয়া ছাত্রীর বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন এই সময়ের বাবা মায়েরা। স্কুলের শিক্ষকদের ছাত্রছাত্রীদের স্কুলমুখি করতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে এখন এই ২০২২ এর প্রায় দোরগোড়ায় এসে আবেদন জানাতে হচ্ছে। তাহলে আমাদের সমাজের অগ্রগতি কতটা ঘটেছে তা নিয়ে একটা প্রশ্নচিহ্ন থেকেই যায়।পরিবেশ ও পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছতে আরও বহু পথ অতিক্রম করা বাকি।
আজও ধর্মের নামে নারীদের অবরূদ্ধ করে রাখার প্রয়াস চালানো হয়। নারীর চলাফেরার ওপর এখনও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। মেয়েদের কাজ ঘরসংসার করা, তাদের অবস্থান অন্তঃপুরে— এমন কথা এখনও সমাজের অনেকেই বিশ্বাস করেন। উদার সমাজ, মুক্ত পরিবেশ আমরা এখনও গড়ে তুলতে পেরেছি কি? উদার ও মুক্ত সমাজ গড়তে আন্তরিক যে প্রয়াসের প্রয়োজন সেই দিকে আমরা কতটা এগিয়েছি? আমি মনে করি এই স্বাধীনতা ব্যাপারটা কেউ কাউকে দেয় না তা নিজের মনে জাগ্রত করতে হয়। আর স্বাধীনতা মানেই স্বেচ্ছাচারিতা নয়। বেশিরভাগ পুরুষ এখনও বিশ্বাস করেন নারী যতটুকু এগোলে তার আয়ত্বের মধ্যে থাকবে ঠিক ততটুকুই তাকে এগোতে দেওয়া দরকার। সব থেকে বড় কথা নারী উন্নয়নে নারীদের ভূমিকাও আজ প্রশ্নবিদ্ধ। সমাজের সার্বিক পরিবর্তনে বর্তমান নারীদের অবস্থান কোথায়? প্রচুর নারী লেখাপড়া শিখছেন। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, এডভোকেট, কিংবা টিচার হতে পারছেন। চাকরির পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হচ্ছেন। কিন্তু জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর নিজের সমাজের জন্য বা মানুষের জন্য কাজ করতে কতজন এগিয়ে আসছেন তা প্রশ্নচিহ্ন থেকে যায়। তাদের সমাজের প্রতি কর্তব্য অন্য মানুষজন এসে করবেন, এই ভাবনাই বোধ করি শেষ পর্যন্ত স্থান পাচ্ছে। ভোগবাদী জীবনে অভ্যস্ত নারীর চাকরি, সন্তানের ক্যারিয়ার, ভালো বাড়ি, গাড়ি এত কিছুর মধ্যে থেকে নিজেদের জংধরা সমাজ নিয়ে বা নিজেদের অবস্থান নিয়ে ভাবার সময় কোথায় তাদের? গত শতাব্দীতে এত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন যা পারেন তা এই শতাব্দীতে অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে বাঙালি নারীদের মধ্যে তার প্রয়াস খুব কম দেখা যায়।
আজও নারী দানের সামগ্রী। আমরা কেন গরু বাছুরের মত অন্য কারো হাতে দান হব এই প্রশ্ন বা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে নারীদের দেখা যায় না। যেখানে উভয়েই উভয়ের প্রয়োজনে পাশে থাকছেন। অথচ হাসবেন্ড নামক ব্যক্তি সেখানে স্বামী বা প্রভু হয়ে বসেছেন। বহু উচ্চ শিক্ষিত নারীদের দেখা যায় তাদের শিক্ষা নিয়ে গর্ব করতে কিন্তু নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রাখতে এখনও খুব কম নারীকেই দেখা যায়। কেউ চাকরি বা ব্যবসা করেন ঠিকই কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে উচ্চ উপার্জন করা কোনো পুরুষকে বিয়ে করে নিজের লাইফ ঐভাবেই সেটেল করতে চান উচ্চ শিক্ষিত বহু নারী। নিজের প্রয়াস খুব কম দেখা যায়। বাবা, ভাই, দাদা হাসব্যান্ডের ওপর নির্ভর করতে করতে তারা যে নিজেরাও সেই কাজটা করতে পারেন সেই মনোবৃত্তিটাই হারিয়ে গেছে নারীদের। কোনো জায়গায় যেতে হলেই সঙ্গে একটি পুরুষ রূপ লাঠির দরকার পড়ে বেশিরভাগ মহিলাদের আজও। আমাদের সমাজ এইটা দেখতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে যদি কচিৎ কোনো মহিলাকে কোনও অনুষ্ঠানে বা কোনো কাজে একা যেতে হয়, তখনও তাকে শুনতে হয় কার সাথে তিনি এসেছেন। এই কথাটা কোনো পুরুষকে শুনতে হয় না। যেন সঙ্গে পুরুষ না থাকলে কোথাও যাওয়া যায় না। একজন চাকুরিরতা মহিলাকেও বিয়ের পিড়িতে বসতে গেলে তার উদারমনা শ্বশুরবাড়ির লোকের কাছে শুনতে হয় তারা দয়া করে চাকরি করতে দেবেন। তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন চাকরি করতে দেওয়ার পারমিশন দেওয়ার হকদার হয়ে যান অলিখিত ভাবে। যেখানে সেই চাকরি জোগাড় করতে একটা পুরুষের সমান তাকে পরিশ্রম করতে হয়েছে। আবার কোনো বাড়ি সেই চাকরিকেই মানতে চায় না। এই হল আমাদের আধুনিক সমাজের দান। কিছু মহিলা তাঁদের আধুনিকতার প্রমাণ রেখেছেন শুধুই বাহ্যিক কিছু আচার ব্যবহার কিংবা কিছু উশৃঙ্খল আচরণের মাধ্যমে। কিন্তু ভেতরর স্বাধীনতা এবং তার সুষ্ঠ সুন্দর পরিমার্জিত বিকাশ এখনও বহু নারীর মধ্যে দেখা যায় না। পুরুষ কেন প্রভুত্ব কায়েম করার পরিবর্তে বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব রাখবেন না সেটা একটা বড় প্রশ্ন। নারীকে তার নিজের কথা নিজেকেই বলতে হবে, অন্য কেউ তার বলা কথা বলে দেবে না। সেই সাহস রাখতে হবে। নিজের দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। তার জন্য নারী পুরুষ তথা সমাজ ব্যবস্থার ও সর্ব স্তরের মনোভাবের পরিবর্তনের প্রয়োজন, যা আমাদেরকেই করতে হবে।
লেখক : গীতশ্রী সাহা, কবি ও প্রাবন্ধিক উত্তর ২৪ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
Leave a Reply