1. admin@pathagarbarta.com : admin :
মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:২২ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
বাংলাদেশ পোয়েটস ক্লাবের দুইদিনব্যাপী সাহিত্য পর্যটন মিশন মহেশখালী কক্সবাজার ৮ ও ৯ নভেম্বর নবীগঞ্জে শারদ সংকলন ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ প্রকাশিত স্বপ্নবিলাস উন্মুক্ত পাঠাগারের উদ্যোগে পাঠ প্রতিক্রিয়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত সৌম্যেন অধিকারীর কণ্ঠে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ স্মরণে প্রথম বাংলা গান মিডল্যান্ডস সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদ ইউকে সভায় বার্মিংহামে বিজয় দিবস পালনের সিদ্ধান্ত লেখা আহবান ইউকের বাংলা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভা অনুষ্ঠিত “রাষ্ট্র সংস্কারে পাঠাগারের ভূমিকা” শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত “রাষ্ট্র সংস্কারে পাঠাগারের ভূমিকা” শীর্ষক সেমিনার লন্ডনে আনন্দ ও উৎসবে দ্বাদশ বাংলাদেশ বইমেলা এবং সাহিত্য সাংস্কৃতিক উৎসব অনুষ্ঠিত

রবীন্দ্র চন্দ্র দাস : আলোকিত মানুষের পথিকৃৎ

পাঠাগার বার্তা
  • আপডেট সময় : শনিবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৪
  • ২৮১ বার পঠিত

রবীন্দ্র চন্দ্র দাস : আলোকিত মানুষের পথিকৃৎ

রত্নদীপ দাস (রাজু)

মানুষ মরণশীল। প্রকৃতির চিরাচরিত নিয়মে এই মায়াময় পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে একদিন চলে যেতে হয়। কালের আবর্তে ঢাকা পড়ে তাঁদের নাম। কিন্তু অমরত্বের বর না নিয়ে আসা মানবজাতির মধ্যে কেউ কেউ তাঁদের মহৎ কর্মের দ্বারা কালের বিবর্তনেও স্মরণীয় হয়ে থাকেন প্রজন্মান্তরে। তাঁদের দেখানো পথ জীবদ্দশায়ই শুধু মানবজাতির কল্যাণে আসেনা, মৃত্যুর বহুকাল পরও মানবকল্যাণে ও মানব সভ্যতা বিকাশে কাজ করে। তেমনি একজন আলোকিত মানুষের পথিকৃৎ বীর মুক্তিযোদ্ধা রবীন্দ্র চন্দ্র দাস।

রবীন্দ্র চন্দ্র দাস সিলেট জেলাধীন নবীগঞ্জ থানার ৩৯নং সার্কেলের (জন্তরী পরগনা) ঐতিহ্যবাহী মুক্তাহার গ্রামের এক সংস্কৃতমনা ও সম্পন্ন পরিবারে ১৩৫২ বঙ্গাব্দের ১লা পৌষের (১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জানুয়ারি) এক শুভক্ষণে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা দীগেন্দ্র চন্দ্র দাস (১৯০৫ – ১৯৭৬) ও মাতা মণিবালা দাস। তাঁর জন্মটা হয়েছিল রবিবারে। তাই বাবা-মা তাঁর নাম রাখেন রবীন্দ্র। আদর করে ডাকতেন ‘রবি’ বলে। রবি (অর্থ্যাৎ সূর্য) যেমন চারদিক আলোকিত করে, তেমনি তিনিও তাঁর মা-বাবার কোল আলোকিত করেছিলেন এবং একটা সময় তাঁর পরিপার্শ্বকে। মাত্র দুই বছর বয়সেই তিনি মাতৃহারা হন। পিতা দীগেন্দ্র চন্দ্র দাস সাংসারিক প্রয়োজনে দ্বিতীয় বার দার পরিগ্রহ করেন তাঁর প্রথম স্ত্রীর ক্ষুরতোত বোন সুক্রতি রানী দাসের সাথে। তিনি পাঁচ ভাই ও তিন বোনদের মধ্যে দ্বিতীয়।

বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন- জেদি, উদ্দমী, স্বাধীনচেতা ও নির্ভীক। যত কঠিন কাজই হোক না কেন, কোন কিছুই দুরূহ মনে করতেন না। বাল্যকালে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা এলাকায় কিংবদন্তির জন্ম দেয়। পাখি শিকার ও খেলাধুলা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন সারাক্ষণ। মাতৃহারা হলেও পিতা, বিমাতা, পিতামহী ও আত্মীয়-প্রতিবেশীদের পরিমন্ডলে অনাবিল স্নেহ ছায়ায় তাঁর বেড়ে ওঠা।

এমনি করে এক সময় তাঁর পিতা মুক্তাহার গ্রামের পার্শ্ববর্তী বৈলাকীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১ম শ্রেণীতে ভর্তি করান দুই সহোদর ধীরেন্দ্র চন্দ্র দাস ও রবীন্দ্র চন্দ্র দাস কে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কৃতিত্বপূর্ণ রেজাল্ট সহকারে পাশ করার পর (অর্থাৎ ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত) নবীগঞ্জ যোগল-কিশোর উচ্চ বিদ্যালয়ে পুনরায় ৪র্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন (তৎকালে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকেই ইংরেজিতে ভিত্তি মজবুত করার জন্য হাইস্কুলে পুনরায় ৪র্থ শ্রেণিতে ভর্তি হতে হতো)। পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন সংস্কৃতমনা। যাত্রাদলে অভিনয় ও গানের ভীষণ অনুরাগী ছিলেন। কোন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই বাউলসংগীত ও লোকসংগীতে পারদর্শিতার পাশাপাশি অভিনয়েও সমান পারঙ্গমনতা অর্জন করেন। তাছাড়া ফুটবল, হাডুডু, দৌড়, সাঁতার, বক্তৃতাসহ সকল প্রতিযোগিতায় কৃতিত্ব অর্জন করেন। ৮ম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়ে সাঁতার প্রতিযোগিতায় হবিগঞ্জ মহকুমার মধ্যে ১ম ও বৃহত্তর সিলেট জেলার মধ্যে ৩য় স্থান অর্জন করেন। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে গভীরভাবে সক্রিয়তার কারণে এক পর্যায়ে পড়াশোনা থেকেই বিদায় নিতে হয় তাঁকে। প্রায় তিন বছর শিক্ষা বিরতি ঘটে তাঁর। এই সময়টায় ফুটবল খেলে, ঘাটু ও যাত্রাদলে অভিনয় এবং গান গেয়েই তাঁর সময় অতিবাহিত হয়।

তিন বছর শিক্ষা বিরতির পর তিনি ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে আবারও পড়াশোনায় মনযোগী হলেন। কিন্তু খেলাধুলা, গান ও অভিনয় চালালেন সমানভাবে। হাইস্কুলে এবং নবীগঞ্জ বাজারে এমন কোন টুর্নামেন্ট, গানের অনুষ্টান কিংবা যাত্রা-থিয়েটার এর আয়োজন হতো না যেখানে তিনি নেই। সর্বত্রই সর্বাগ্রে ছিল তাঁর অবস্থান। এই সময়টায় তিনি সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে এসব কাজের জন্য যাতায়াত করতেন। পড়াশোনার পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে তাঁর শিক্ষক বাবু রামদয়াল ভট্টাচার্য, জনাব আব্দুল আজিজ চৌধুরী, বাবু কৃষ্ণ চন্দ্র নাথ, বাবু চারু চন্দ্র দাস প্রমুখ শিক্ষক মন্ডলীর এক প্রিয় পাত্রে পরিণত হন। পাশাপাশি নবীগঞ্জের সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা জমিদার শ্যামাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত (বিধুবাবু), জনাব মিম্বারুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ নেতৃবৃন্দের প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেন। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্যদিয়ে নবীগঞ্জ উপজেলা ব্যাপী ছাত্রাবস্থায়ই তিনি এক বিশাল পরিচিতি লাভ করেন।

নবম-দশম শ্রেণী বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার তিন মাস পূর্বে বিভাগ পরিবর্তন করে মানবিক বিভাগে চলে যান (ঐ সময়ে পরীক্ষার পূর্বে বিভাগ পরিবর্তন করা যেত)। তিন মাস মানবিক বিভাগের বই পড়েই উচ্চতর ২য় বিভাগে ১৯৭০ সালে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হন। উমেদনগর লজিং বাড়ীতে ছাত্র পড়ানোর বিনিময়ে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়। এখানে থেকেই একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি পড়া হয়। কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি চালিয়ে যান তাঁর অন্তরের গভীরতম প্রদেশে লালন করা গান ও অভিনয় চর্চা। তিনি ছাত্র হিসেবে যেমন ছিলেন মেধাবী, তেমনি হবিগঞ্জে ছাত্র ইউনিয়ন রাজনীতিতেও ছিল তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহন। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির মাধ্যমে বৃন্দাবন কলেজের ছাত্র সংসদ রাজনীতিতেও ছিলেন সক্রিয়। ভূমিকা রাখেন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচীতে। এই সময়টা অর্থ্যাৎ ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সালটা ছিল উত্তাল। এই সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক কর্মকান্ডে হবিগঞ্জ আসলে, তাঁর সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগও হয় তাঁর। [ এসময় বঙ্গবন্ধুর সাথে করমর্দনের সময় বঙ্গবন্ধুর বিশাল দেহী হাতের আঙুলের চাপ তাঁর মনে বহুদিন গেঁথে ছিল ]। বঙ্গবন্ধুর (হবিগঞ্জের) রক্তে আগুন লাগা জ্বালাময়ী ভাষণে উদ্ভুদ্ধ হয়ে দেশমাতৃকা মুক্ত করার সংগ্রামে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন তিনি। একটা সময় সারা দেশের ন্যায় হবিগঞ্জেও গগন বিদারী শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সকল স্কুল-কলেজে, হাটে-বাজারে, গ্রামে-গঞ্জে সারা বাংলায়। শ্লোগানগুলো ছিল-

‘জিন্না মিয়ার পাকিস্তান, আজিমপুরের গোরস্থান’;
‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ।’
‘জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও, পাকিস্তানের পতাকা’;
‘ঘরে ঘরে উড়িয়ে দাও, স্বাধীন বাংলার পতাকা।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারাদেশ জুড়ে যখন স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু হয়, তখন যুবক রবীন্দ্রও স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে যুদ্ধে যোগদানের প্রত্যয় নিয়ে বাড়ী ফিরেন। নবীগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি পুরুষ জননেতা শ্যামাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত (বিধুবাবু) এর নেতৃত্বে কাজ শুরু করেন। এলাকায় তখন মুক্তিবাহিনী গঠনের পাশাপাশি চলছে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠনের কাজ।

একাত্তরের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর দেশ একটি অনিবার্য যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যায়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো নবীগঞ্জেও লাগাতার মিছিল মিটিং শুরু হয়। নবীগঞ্জ জে,কে হাইস্কুলের প্রাক্তন ছাত্ররাই ছিলেন এসব মিছিল মিটিং এর উদ্যোক্তা। প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে রবীন্দ্র চন্দ্র দাসও এসব ঐতিহাসিক কর্মকান্ডে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় হানাদার বাহিনীর আক্রমনও তীব্র হতে শুরু করে। এ সময় মনসা পূজার হাটে পাকিস্তানি দোসরদের অন্যতম নবীগঞ্জ থানার শান্তি কমিটির আহবায়ক মাওলানা মোহাম্মদ ইসমাইল ও সদস্য সচিব আব্দুর রহমান এর সহায়তায় ও প্ররোচনায় হানাদারদের একটি ইউনিট নবীগঞ্জ আক্রমন করে বর্বরতম হত্যাকান্ড সংঘটিত করে। ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করে শ্রীশ্রী কালীবাড়ী ও শ্রীশ্রী কানাই লাল জিউড় আখড়া (প্রতিষ্ঠান দুটি বর্তমানে নবীগঞ্জ থানার দখলে আছে), হামলা করে শ্রীশ্রী মদনমোহন জিউড় আখড়া ও শ্রীশ্রী গোবিন্দ জিউড় আখড়ায়। আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয় পূর্ব বঙ্গের তিনটি ঐতিহাসিক রথের একটি নবীগঞ্জের শ্রীশ্রী গোবিন্দ জিউড় আখড়ার ঐতিহ্যবাহী রথ। এই গণ-হত্যার পর নবীগঞ্জের সর্বত্র ত্রাস সঞ্চারিত হয়। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায় দেশে অবস্থান করা অনিরাপদ মনে করে জন্মভিটে ত্যাগ করে ভারতে শরনার্থী হিসেবে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এসময় সমগ্র মুক্তাহার গ্রামটি সম্পূর্ণ জনশূন্য হয়ে যায়। রবীন্দ্র চন্দ্র দাস পরিবার পরিজন সহ ভারত গমন করেন এবং মৈলাম শরনার্থী ক্যাম্পে পরিবার-পরিজনদের রেখে বাবা-মাসহ পরিবারের অন্যান্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিং ক্যাম্পে উপস্থিত হন। ৫নম্বর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মীর শওকত আলী তাঁকে রিক্রুট করেন। রিক্রুট হওয়া সদস্যদের থেকে শিক্ষিত ও কলেজ ছাত্রদের বাছাই করে আলাদা একটি ব্যাচ তৈরি করে প্রথম ১৫/২০ দিন মেঘালয় রাজ্যের UK&J HILL (ইউনাইটেড কাশিয়া জৈন্তা পাহাড়) ডিংরাই সেন্ট্রাল ইয়ুথ ক্যাম্পে (কেন্দ্রীয় যুব শিবির) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণের এক পর্যায়েই পাক-হানাদার বাহিনী ছাতক আক্রমন করে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরী দখল করে নেয়। পাক হানাদারদের সীমান্তের কাছাকাছি এই অঞ্চল থেকে হটানোর জন্য ভারতীয় একটি বাহিনীও পাল্টা আক্রমন করে। ভারতীয় বাহিনীর সাথে এই ব্যাচের রবীন্দ্র চন্দ্র দাস সহ অন্যান্যরাও এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধ যখন চরম আকার ধরাণ করে, তখন ৫নম্বর সেক্টরের বাছাই করা শিক্ষিত ও সাহসী ৩০ যুবককে নিয়ে (WAR Trained Intiligent and Security Branch) স্পেশাল ব্যাচ-২ গঠন করলে যুব শিবিরের প্রশাসক ভারতীয় ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট (অব:) এন সি বসাক (নরেন্দ্র চন্দ্র বসাক) মহোদয়ের নির্দেশে ৩০ জনের একটি শিক্ষিত যুবকদলকে মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের মেঘালয় রাজ্যের জুয়াই এলাকার ইস্টার্ন কমান্ড ওয়ান (ইকোওয়ান) এ পাঠানো হয়। এই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন রবীন্দ্র চন্দ্র দাস। এদিকে একদিন তাদেরকে এক অজানা গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হয়। কোথায় নেয়া হচ্ছে তা জিজ্ঞেস করা কঠিন ভাবে নিষিদ্ধ ছিল। এই গন্তব্যের যাত্রা পথেই সর্বাধিক বৃষ্টিবহুল এলাকা চেরাপুঞ্জিতে কিছু সময় বিশ্রাম নেয়া হয়। তারপর তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় এক পাহাড়ের সুউচ্চ টিলায়। এটিই তাদের ট্রেনিং ক্যাম্প। জানানো হয় এই ট্রেনিং ক্যাম্পের নাম ‘ইকো ওয়ান’। এখানেই তাঁদের ট্রেনিং চলল। ভৌগলিক এবং অবস্থানগত কারণেই এখানে গুলাগুলির প্রশিক্ষণ চালালেও টিলার অপর পাশ থেকে কোনো শব্দ শুনা যেতনা। নিরব নিঝুম এলাকা। জন মনিষ্যির চিহ্নমাত্র নেই, এমনকি পাখ-পাখালির শব্দও নেই। সরল নামক এক প্রকারের গাছের ঘন বুনট। পত্র-পল্লবের ফাঁক দিয়ে আকাশও দৃষ্ট হয়না। এই নিবিড় অরণ্যের ফাঁকে ফাঁকেই অনেক গুলি তাবু খাটানো। প্রতি তাবুতে ১০/১২ জন করে সদস্য। ইন্টেলিজেন্ট ব্রাঞ্চের কার্যক্রমের উপর সেখানে সরাসরি ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ২১দিন প্রশিক্ষণে মার্কা থার্ড, থ্রী নট থ্রী রায়ফেল, এস এম জি, এস এল আর, এল এম জি, বিভিন্ন প্রকার মাইন, ডেমুলিশন, টেলি কমিউনিকেশন, বিভিন্ন ব্যাসের মর্টার, হ্যান্ড গ্রেনেড ইত্যাদি অস্ত্রের উপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

বাছাইকৃত শিক্ষিত যুবকদের ইন্টেলিজেন্ট ব্রাঞ্চের উপর (WAR Trained Intiligent and Security Branch) কার্যক্রমে ২১ দিনের প্রশিক্ষণে তাঁদের প্রশিক্ষক ছিলেন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা লাল সিং রাহুত সহ আরও কয়েকজন। স্পেশাল ব্যাচ-২ (WAR Trained Intiligent and Security Branch) এর অন্যান্য বীর মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- (১) রসরাজ বৈদ্য, জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জ, (শপথ নামা পাঠ করান) (২) অহীন্দ্র চৌধুরী, জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জ, (৩) নিবারণ দাশ, চৌকী, নবীগঞ্জ, (৪) উপেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ, সিলেট, (৫) প্রভাত শুক্লবৈদ্য, জগন্নাথপুর (৬) মানিক লাল দে, সিলেট সদর (৭) বারীন্দ্র কুমার সূত্রধর, সিলেট সদর (৮) মনোরঞ্জন চক্রবর্ত্তী, সিলেট সদর (৯) রসেন্দ্র কুমার চৌধুরী, রাজারগাঁও সিলেট সদর (১০) গৌরাঙ্গ দেবনাথ, সিলেট সদর (১১) নীরেন্দ্র চন্দ্র নাথ, সিলেট সদর (১২) কুকিল মনি শর্মা, সিলেট সদর (১৩) প্রমোদ মল্লিক, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা, (১৪) উপেন্দ্র চন্দ্র দাস, মুক্তাহার, নবীগঞ্জ, (১৫) রবীন্দ্র চন্দ্র দাস (মাস্টার), ভাঙ্গাডর, দিরাই (১৬) পরিমল চন্দ্র দেবনাথ, তাড়াইল, কিশোরগঞ্জ, (১৭) মুকুল চন্দ্র দাস, মাকালকান্দি, বানিয়াচং (১৮) বনমালী বৈদ্য, কামারখাল, জগন্নাথপুর, (১৯) গঙ্গেশ চন্দ্র দাস, চৌকী, নবীগঞ্জ, (২০) প্রহল্লাদ চন্দ্র দাস, চৌকী, নবীগঞ্জ, (২১) অবনী দাস, হায়াতপুর, খালিয়াজুড়ি, (২২) হিমাংশু দাস, মাকালকান্দি, বানিয়াচং, (২৩) সুধীর চন্দ্র দাস, উমাইরগাঁও, সিলেট সদর, (২৪) পরিমল দত্ত, করেরপাড়া, সিলেট, (২৫) জীতেন্দ্র চন্দ, দোয়ারাই, ছাতক, (২৬) প্রদীপ জ্যোতি পাল, জাঙ্গাইল, সিলেট, (২৭) রসরাজ বিশ্বাস, চাকুয়া, খালিয়াজুরি, (২৮) শংকর কুমার দাস, ফরিদপুর নেত্রকোনা সদর, (২৯) স্মৃতিভূষণ ভৌমিক, চাকুয়া, খালিয়াজুরি প্রমূখ ছিলেন স্পেশাল ব্যাচ-২ এর মুক্তিযোদ্ধা।

ট্রেনিং শেষে ডিংরাই ইয়ূথ ক্যাম্প প্রশাসক ফ্লাইট ল্যাফটেন্যান্ট (অব:) নরেন্দ্র চন্দ্র বসাকের (এন সি বসাক) নির্দেশে এই ৩০ জনকে ৫নম্বর সেক্টরের ৬টি সাব-সেক্টরে ৫জন করে ভাগ করে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে প্রেরণ করা হয়। তিনি সাথী সহযোদ্ধাদের সাথে ৫নম্বর সেক্টরের টেকারঘাট সাব-সেক্টরে আসেন এবং সাব-সেক্টরের কমান্ডার ক্যাপ্টেন মোসলেম উদ্দিন ওরফে দীন মোহাম্মদ এর অধীনে মুক্তিযুদ্ধের স্বশস্ত্র পর্বে অংশগ্রহণ করেন। একটা সময় ক্যাপ্টেন দীন মোহাম্মদের সাথে মুক্তিযোদ্ধােদের সমস্যা দেখা দিলে, উপরের নির্দেশে রবীন্দ্র চন্দ্র দাস বালাট সাব-সেক্টরে চলে আসেন। বালাট সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন এম এ মোত্তাল্লিব। ক্যাপ্টেন এম এ মোত্তাল্লিব সাহেবের অধিনে তিনি- ভাতের টেক, পলাশ, আম বাড়ি, বৈষের ভের, চিনাকান্দি, গৌরারং, টেংরাটিলা, ডলুয়া প্রভৃতি স্থানে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি একবার মৃত্যুর মুখে পতিত হন। সেখানকার আদিবাসী এক মহীয়সী নারীর কারনে সে যাত্রায় তিনি বেঁচে যান। এ সময় একদিন ৪নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর সি আর দত্ত ক্যাম্প পরিদর্শনে আসলে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে অনুপ্রেরণার সৃষ্টি হয়। বাকি দিনগুলিতে ক্যাপ্টেন এম এ মোত্তাল্লিব সাহেবের কমান্ডেই তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যান।

১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পর বাড়ি ফিরে আসেন। সেই সময় মুক্তাহার গ্রামটি করোন চিত্র তাঁর বিভিন্ন সময়ের কথায় ফুটে ওঠে। বাড়ি-ঘর বলতে শূন্য ভিটায় আগাছার জঙ্গল। ঘর-দুয়ারের চিহ্নমাত্র কোথাও নেই। শরনার্থী হিসেবে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর প্রতিবেশী গ্রামের কিছু অসাধু লুটেরা বাড়ির ভিটে টুকু ছাড়া সব কিছু লুটে নিয়ে গেছে। একদিকে যুদ্ধে বিজয়ী বেশে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আনন্দ, অন্যদিকে বিরান গ্রামের সকরুণ চিত্র তাঁকে মর্মাহত করে। কিন্তু জীবনতো থেমে থাকেনা, থাকতে পারেনা। তাই তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নতুন করে জীবন সংগ্রাম শুরু করেন।

১৯৭২ সালের প্রথম দিকে হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজ কর্তৃক এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তিনিও এতে অংশ গ্রহণ করেন। এই অনুষ্ঠানে শর্ত ছিল একজন শিল্পী শুধুমাত্র একটি গানই পরিবেশন করতে পারবেন। কিন্তু তাঁর গানটি শেষ হতে না হতে মুহুর্মুহু শ্লোগান উঠতে থাকলে আয়োজক কমিটি তাঁকে পুনরায় গান গাওয়ার সুযোগ দেন এবং এই অনুষ্ঠানে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। এই অনুষ্টানে অনেক গুণীশিল্পীরাও অংশগ্রহন করেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম সুবীর নন্দী (দেশের প্রখ্যাত শিল্পী)।

তারপর জীবন জীবিকার তাগিদে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে তাঁকে নামতে হয় কঠিন এক জীবন সংগ্রামের পথে। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চাকুরী প্রতিযোগিতায় নেমেই আশাতীত সুযোগ পান একই সাথে তিনটি পদে উত্তীর্ণ হয়ে। পদ তিনটি হলো পুলিশ বিভাগে সাব-ইন্সপেক্টর, চা বাগানের টিলা বাবু এবং প্রাইমারী স্কুলের সহকারী শিক্ষক। তাঁর পিতার নির্দেশে ও শিক্ষা বিস্তারের প্রতি গভীর আগ্রহের কারণে শিক্ষকতাকেই জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের ১ জুন তারিখে যোগদান বোরহানপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে।

১৯৭৪-১৯৭৫ শিক্ষাবর্ষে তিনি হবিগঞ্জ প্রাইমারী টিচার্স ট্রেনিং ইন্সট্রিটিউশন থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হন। সেখানেও তাঁর গান তথা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড শিক্ষক মন্ডলী ও সহপাঠিদের অভিভূত করে। প্রশিক্ষণ শেষে আবার শিক্ষকতা পেশায়। এবার তাঁকে প্রধান শিক্ষক পদে প্রমোশন দিলে তিনি সহকারী শিক্ষকপদে থাকতে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। উল্লেখ্য যে, এই ভাবে তাঁকে তিনবার ডিপার্টমেন্টাল প্রমোশন দিলে তিনি নাকচ করেন এবং শেষ পর্যায়ে তিনি লিখিত দেন যে, তিনি চাকুরী জীবনে কখনো প্রধান শিক্ষক পদে দায়িত্ব নেবেন না। অত্যন্ত আন্তরিকভাবে তিনি ছাত্রদের পাঠদান করতেন। তাঁর কড়া শাসন, দৃঢ় মনোবল, ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও জ্ঞানগর্ভ পাঠদান পরীক্ষায় সফলতা বিশেষ করে সেন্টার পরীক্ষা ও বৃত্তি পরীক্ষায় তাঁর ছাত্রদের বিশেষ কৃতিত্ব অর্জনে শিক্ষক হিসেবে তাঁর নামডাক বাড়তে থাকে। ছাত্ররা তাঁকে যেমন প্রচন্ড রকমের ভয় পেত, তেমনি তিনি ছাত্রদের ও অভিভাবকদের ভালবাসা ও শ্রদ্ধায় হতেন সিক্ত। তিনি যেই স্কুলেই যোগদান করতেন সেই স্কুলের রেজাল্ট দ্রুত গতিতে বেড়ে যেত এবং প্রাথমিক বৃত্তি আসত সেই স্কুলে। এক পর্যায়ে তাঁর নিজ গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা কালীন সময় বড় শাখোয়া গ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাঁকে অনুরোধ করে তাঁদের স্কুলে নিয়ে যায় এবং বড় শাখোয় স্কুলে কয়েক বছর থাকার পর অনুরুপভাবে পাশ্ববর্তী বৈলাকীপুর স্কুলে যোগদান করেন। বৈলাকীপুর স্কুলেই তিনি তাঁর ৪২ বছরের সুদীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের ৩০ বছর অত্যন্ত সুনাম ও সম্মানের সাথে শিক্ষতা করেছেন।

জীবনাচারে তিনি ছিলেন- ভদ্র, সজ্জন, সংস্কৃতমনা, পরোপকারী, শৌখিন, নির্লোভ, নির্ভিক ও উন্নত রুচির অধীকারী। পড়তেন কালো পেন্টের সাথে সাদা টাইপওয়ালা কিংবা মানান সই শার্ট, কখনো কখনো সাদা পাঞ্জাবির সাথে সাদা পায়জামা বা ধুতি। একজন অনন্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন হিসেবে সবাই তাঁকে মান্য করত। শিক্ষকতা পেশার পাশাপাশি তিনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যেমন ছিলেন সক্রিয়, তেমনি তিনি এলাকার বিচার-বৈঠক ও বিভিন্ন সামাজিক অসন্তুষ জনক কর্মকান্ড সমাধানে ছিলেন অগ্রগণ্য। শিক্ষকতা, সামাজিকতা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে আসতে আসতে তিনি এক অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে উঠেন। ‘রবীন্দ্রবাবু’ বা ‘রবীন্দ্র মাস্টারবাবু’ এই নামেই তিনি বিভিন্ন এলাকার সামাজিক ও পেশাজীবী শ্রেণি, নবীগঞ্জের আপামর জনসাধারণ এবং আশেপাশের এলাকার মানুষের কাছে ছিলেন অত্যন্ত সুপরিচিত ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব।

আশির দশকে সরকার উপজেলা পরিষদ গঠন করলে উপজেলা শিক্ষা কমিটি শ্রেষ্ট শিক্ষক নির্বাচন করেন। উল্লেখ্য যে, তখন শুধুমাত্র প্রধান শিক্ষকদের মধ্য থেকেই ‘শ্রেষ্ট শিক্ষক’ নির্বাচন করা হতো। কিন্তু ১৯৮৬ সালে শিক্ষা কমিটির মিটিংয়-এ আলোচনা হয় যে- “যদি কোন শিক্ষক তাঁর মেধা, মননশীলতা ও যোগ্যতা দ্বারা শ্রেষ্ট শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন, তাহলে তিনি প্রধান শিক্ষকই হোন অথবা সহকারী শিক্ষকই হোন তাঁকে “শ্রেষ্ট শিক্ষক” এর মর্যদা দেওয়া কর্তব্য।” এ বছরই অর্থ্যাৎ ১৯৮৬ সালেই তিনি “শ্রেষ্ট শিক্ষক” নির্বাচিত হন। তাছাড়া শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক আয়োজিত এবং বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক আয়োজিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তিনি বিচারক হিসেবে নন্দিত হন।

২০০৫ সালে বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি নবীগঞ্জ উপজেলা কমিটি গঠনের লক্ষ্যে সরাসরি প্রথম বারের মতো আড়ম্বরপূর্ণভাবে প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তিনি সিনিয়র সহ-সভাপতি পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। সমিতির কার্যক্রমে মেধা ও প্রজ্ঞা দ্বারা সংগঠনকে শক্তিশালী করনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এছাড়া সমিতির কয়েকটি নির্বাচনে তিনি নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব নিরপেক্ষতার সাথে পালন করেন। বিভিন্ন কার্যক্রমে তিনি শিক্ষক সমাজের অভিভাবকের ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের দায়িত্বশীল পদে না থেকেও তিনি মুক্তিযুদ্ধাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সম্মুখ সারিতে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন।

সংস্কৃতমনা এই ব্যক্তিত্ব শেষ জীবনে এসেও সংগীতের সাথে ছিলেন অবিচ্ছেদ্য প্রাণ। এই সময়ে তাঁকে লোকসংগীত ছাড়াও ভক্তিমূলক ও পদাবলী কীর্তনের প্রতি আগ্রহী হতে দেখা যায়। নবীগঞ্জে এমন কোনও হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্টান নেই, যে তাঁর নিমন্ত্রণ ও উপস্থিতি নেই। আয়োজক ও ভক্তবৃন্দ তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে দেখতেন। দেশ-বিদেশের অনেক নামী দামী পদাবলী কীর্তনীয়ারাও তাঁর গান, সুর ও সংগীতের প্রতি তাঁর উচ্চতর ধ্যান-জ্ঞানের জন্য প্রশংসা করতেন। অনেক কীর্তনীয়াগণ কীর্তন পরিবেশনের সময় তাঁকে উপস্থিত থাকার অনুরোধ করতেন, তাঁদের ভুল সংশোধনের জন্য। তিনি গীতা বা ভাগবত পাঠক না হলেও অনেক গুণী পাঠক তাঁর সান্নিধ্য পেতে আগ্রহ বোধ করতেন। পাশাপাশি তিনি একজন লেখকও। তাঁর লেখা বেশ কিছু প্রবন্ধ/নিবন্ধ রয়েছে। ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ সম্পাদিত জে,কে হাইস্কুলের শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানের স্মারকগ্রন্থ ‘রোদেলা কিশোর দিন’, নবীগঞ্জ উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষকদের সম্পাদিত ও প্রকাশিত ‘হীরেন্দ্র দাশ আদর্শ সম্মান’ স্মারকগ্রন্থ, নবীগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের চারদশক পূর্তিতে স্মারকগ্রন্থ ‘বিজয় বার্তা’, আবদুল আজিজ চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ ‘মৃত্যুঞ্জয়ী বীর’, শারদীয় সংখ্যা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’, সহ বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁর লেখা মূল্যবান প্রবন্ধ স্থান করে নিয়েছে। এছাড়াও তিনি শ্যামাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত (বিধুবাবু) ও আলাউদ্দিন আহমেদ স্মরণে প্রবন্ধ ও কয়েকটি গান রচনা করেছেন।

৩১ জানুয়ারী ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সুন্দর-সুঠাম দেহের অধিকারী, সদালাপী, সদাহাস্যোজ্জ্বল রবীন্দ্রবাবুকে সত্বরোর্ধ্ব বয়সেও তারুন্যদৃপ্ত দেখা যেত। কোন প্রকার ব্যধি তাঁর শরীরে বাসা বাঁধতে পারেনি। খাওয়া-দাওয়া ও জীবনযাপনে ছিলনা কোনও ডাক্তারি নিষেধাজ্ঞা। সুস্থ স্বাভাবিক চলাফেরা, জীবনযাপন প্রণালী অত্যন্ত গোছানো। কিন্তু ২০১৭ সালের ১লা অক্টোবর (দুর্গাপূজার দশমীর পরদিন) হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। একমাস এক সপ্তাহ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মোটামোটি স্বাভাবিক ছিলেন। এরপর ভর্তি হন সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল হাসপাতলে। সেখানে ৫ দিন থাকার পর ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে ১৫ দিন, পরে ভারতের মাদ্রাজ শহরের গ্লোবাল হসপিটাল সিটিতে ১২ দিন চিকিৎসা করে ফিরে এসে সিলেট নর্থ-ইস্ট মেডিক্যাল হাসপাতালের আইসিইউতে ৩ দিন থাকার পর ১৪ ডিসেম্বর বাড়ী ফিরেন। ১৬ ডিসেম্বর অর্থ্যাৎ বিজয় দিবসের দিন রাত ৮.২১ মিনিটে শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণকালীন সময়ে সাধনোচিত ধামে গমন করেন ৭১’র অকুতোভয় বীর সেনানী, কিংবদন্তি শিক্ষক ও নবীগঞ্জের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্র চন্দ্র দাস। রাত ১১.৪৫ ঘটিকায় নবীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিয়োগলের করুন সুর আর স্বশস্ত্র ধ্বনির মধ্যদিয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দানের পর পারিবারিক শশ্বানে অন্তেষ্ঠিক্রিয়া করা হয়। মৃত্যুকালে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সহ অসংখ্যক গুণাগ্রাহী রেখে যান। তাঁর মৃত্যুতে নবীগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি সহ রাজনৈতিক-সামাজিক নেতৃবৃন্দ ও এলাকাবাসীর উদ্যোগে ২৫ জানুয়ারি ২০১৮ ইংরেজি তারিখে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর জন্মস্থান মুক্তাহার গ্রামে তাঁর নামানুসারে স্থাপিত ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রী রবীন্দ্র চন্দ্র দাস গ্রন্থাগার’- এ ২০২০-২১ অর্থবছরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভবন নির্মিত হয় এবং ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন করেন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব জনাব এনামুল হাবীব। তাছাড়া হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক জনাব ইশরাত জাহানের অনুদানে গ্রন্থাগারে একটা ম্যুরাল নির্মান করা হয়, যা তাঁর স্মৃতির স্মারক হয়ে থাকবে। বীর মুক্তিযোদ্ধা রবীন্দ্র চন্দ্র দাস ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী মানবতাবোধ সম্পন্ন একজন দেশপ্রমিক তথা আদর্শবান ব্যক্তিত্ব। আজীবন তিনি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও আলোকিত জাতি গঠনে কাজ করে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশের এক সূর্য সন্তানের প্রস্থান হলো, যা অপূরণীয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, এলাকার শিক্ষাবিস্তার, সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও নবীগঞ্জের সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের এক গৌরবদৃপ্ত ব্যক্তিত্ব হয়ে তিনি বেঁচে রইবেন।

লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, পাঠাগার বার্তা; প্রতিষ্ঠাতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রী রবীন্দ্র চন্দ্র দাস গ্রন্থাগার, মুক্তাহার, নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরও খবর

ফেসবুকে আমরা

এক ক্লিকে বিভাগের খবর

error: Content is protected !!