মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার
দেবেশ চন্দ্র সান্যাল
২৫ মার্চ’৭১ পাকিস্তান সামরিক সরকারের নির্দেশে পাকিস্তানি সৈন্য বাঙালিদের ওপর “অপারেশন সার্চ লাইট” শুরু করে। অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর পর তদানীন্তন বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা, শেষবাণী ও একটি পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য বাংলাদেশে থাকা পর্যন্ত এদেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। আমরা জাতির পিতার নির্দেশে জীবন পণ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছিলাম। ১৯৭১ সালের ২৬মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জণ পর্যন্ত আমাদের দেশে মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। আমি দেশের ক্রান্তি কালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলাম। প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে পকিস্তানি সৈন্য ও তাদের এদেশিয় দোসরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার উদ্দেশে যাত্রা করার দিন টি ছিল ২৩ জুলাই’৭১ (৬ শ্রাবণ ১৩৭৮) শুক্রবার রাত ৯ টা প্রায়। আমি এম.পি.এ জনাব মো: আব্দুর রহমান স্যারের সাথে আরো অন্যান্য ২২ জন সহ মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পাকিস্তানি হানাদারেরা ২৫ মার্চ’৭১ রাত সাড়ে ১১ টার পর “অপারেশন সার্চলাইট” নামক বিশে^র জখন্নতম জ¦ালাও,পোড়াও ও হত্যা সহ বিভিন্ন মানবতা বিরোধী কাজ শুরু করেছিল। ২৫ মার্চ’৭১ এর পর পাকিস্তানি সৈন্যরা সারাদেশের অধিকাংশ স্থানে আর্মি ক্যাম্প স্থাপন করে তাদের দখলে নিয়ে নেয়। ৭০-এর নির্বাচনে পরাজিত আমাদের দেশের জামায়াতে ইসলামী সহ ইসলামী অধিকাংশ দলের নেতা/কর্মীরা পাকিস্তানি সৈন্যদের পক্ষ নিল। তাদের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সৈন্যদের সহযোগিতা করার জন্য শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও অন্যান্য বাহিনী গড়ে উঠলো। সারাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যরা জ¦ালাও,পোড়াও, লুটতরাজ, হত্যাা, গণহত্যা নারী, নির্যাতন, ধর্ষণ, জোর করে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তর করণ সহ বিভিন্ন মানবতা বিরোধী কাজ করতে থাকলো। পাকিস্তানি সৈন্যদের সহযোগিতা করছে এদেশের বিভিন্ন স্বাধীনতা বিরোধীরা। আমি মুক্তিযুদ্ধে গেলে নিশ্চিত মারা যাব। এই ভেবে বাবা-মা কিছুতেই মুক্তিযুদ্ধে যেতে সম্মতি দিতেন না। তাই বাবা-মা ও বাড়ির অন্য কাউকেও না জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। রওনা হওয়ার আগে আমার পড়ার খাতা ছিড়ে মাকে একটা চিরকুট লিখলাম। “ মা, প্রনাম নিও, বাবাকে আমার প্রনাম দিও। বড় দাদা, মেজদাদা, ও বৌদিকে প্রনাম দিও। ছোট ভাই বোনকে ¯েœহাশিষ দিও। আমি মুক্তিযুদ্ধে গেলাম। তোমাদেরকে বলে গেলে যেতে দিতে না জন্য না বলে চলে গেলাম। অপরাধ ক্ষমা করিও। আশীর্বাদ করিও। আমি যেন বিজয়ী হয়ে তোমাদের কাছে ফিরে আসতে পারি। ইতি- তোমার ছেলে দেবেশ।”
যাবার সময়ে বাড়ির কাউকে জানিয়ে যাইনি। আমরা সুজানগর থানার সাত বাড়িয়া হয়ে পদ্মা নদী পাড় হয়ে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর থানার চিলমারি ইউনিয়নের খারিজাথাক গ্রাম দিয়ে বাংলাদেশের বর্ডার অতিক্রম করলাম। আমরা ভারতের পশ্চিম বাংলার জলঙ্গী বর্ডার দিয়ে ভারতে ঢুকলাম। এম.পি.এ স্যার আমাদের কে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষনের ভর্তির ব্যবস্থা করে দিয়ে তিনি অস্থায়ী প্রবাসী সরকারের উদ্দেশে কোলকাতা চলে গেলেন। আমরা প্রথমে গিয়ে পৌঁছালাম কামারপাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে। বয়সের স্বল্পতার কারণে প্রথম ট্রেনিং কর্তৃপক্ষ আমাকে ভর্তি করতে চাইলেন না। বাধ্য হয়ে ক্যাম্প থেকে চলে গিয়ে কয়েক দিন ভারতের আমার পিসে মহাশয় বিশ^ নাথ ভট্রোচার্য, ছোট ঠাকুরদা মনিন্দ্র নাথ সান্যাল এর বাড়ি সহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে ঘুরলাম। আবার ফিরে এলাম কামার পাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে।৭নং সেক্টরের উপদেষ্টা সাথিঁয়া বেড়া নির্বাচনী এলাকার এম এন এ মালঞ্চ (কুড়মাইল) অধ্যাপক আবু সাইয়িদ স্যার কে অনুরোধ করলাম। কামারপাড়া ইয়ুথ ক্যাম্প কর্তৃপক্ষকে আমাকে ভর্তি করার জন্য বিশেষ অনুরোধ করলাম। কর্তৃপক্ষ আমার একটা ইন্টার ভিউ নিলেন। আমার দেশ প্রেম, সাহসী মনোভাব ও অন্যান্য শুনে ভর্র্তি করলেন। প্রাথমিক ট্রেনিং ক্যাম্পে শুধু আমাদের ফলইং করিয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়ানো হত আর পিটি প্যারেড করানো হত। কদিন কামারপাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে থাকার পর আমাকে, রবীন্দ্র নাথ বাগচী, রতন কুমার দাস ও মো: নজরুল ইসলাম কে ট্রান্সফার করলো মালঞ্চ ট্রানজিট ক্যাম্পে। সেখান থেকে আমাদের কে আনা হলো পতিরাম ক্যাম্পে। পতিরাম ক্যাম্প থেকে এক যোগে ভারতীয় আর্মি লরিতে আমাদের ২০/২২ জন কে নিয়ে আসা হলো দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমার পানিঘাটা নামক ইন্ডিয়ান আর্মি ট্রেনিং ক্যাম্পে। এই ট্রেনিং ক্যাম্প টি ছিল ভারতের শিলিগুড়ি মহকুমার পানিঘাটা নামক স্থানে। পানিঘাটা স্থান টি ছিল চারি দিকে পাহাড়ের মধ্যে। কার্শিয়ান পাহাড় হইতে নেমে আসা একটি ক্যানেলের দক্ষিণ পার্শে¦র বনাঞ্চল। ক্যাম্পে নিয়ে আমাদের তাবুর মধ্যে থাকার সিট করে দিল। আমাদের প্রত্যেক কে একটা মগ, একটা প্লেট দুইটা গেঞ্জি, ইংলিশ প্যান্ট ও অন্যান্য দেওয়া হলো। ট্রেনিং শুরু হলো। আমাদের কোম্পানী ২১ দিনের ট্রেনিং হলো। আমাদের কোম্পানীর নাম ছিল – ডেলটা কোম্পানী আমাদের কে থ্রিনট থ্রি রাইফেল, এল,এম,জি, এস,এল,আর, ষ্টেনগান, টুইঞ্চ মর্টার, হ্যান্ড গ্রেনেড চার্জ, এক্সপ্লোসিভের ব্যবহার সহ অন্যান্য ট্রেনিং দিল। যুদ্ধে সহযোদ্ধা আহত হলে করণীয় সর্ম্পকে ফাষ্ট এইড সম্পর্কে ধারণা দিল। আমাদের ভারতীয়, কয়েক জন হিন্দু বিহারী ও শিখ সৈন্য প্রশিক্ষন দিল। আমাদের কোম্পানীর প্রধান প্রশিক্ষক ছিলেন শিখ সেনা ক্যাপটেন ডি.এস. ভিলন স্যার। আমাদের বিদায়ের সময়ে তাঁর কাছ থেকে জানলাম আমার এফ.এফ নং-৪৭৪২। ট্রেনিং শেষে আমাকে রবীন্দ্র নাথ বাগচী, মো: নজরুল ইসলাম ও রতন কুমার দাস ও অন্যান্যদের কে নিয়ে আসা হলো ৭ নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার কালিয়াগঞ্জ থানার তরঙ্গপুরে। তরঙ্গপুর এনে সিরাজগঞ্জ জেলার ১০ জনের সমন্বয়ে একটি গেরিলা গ্রæপ করা হলো। আমাদের গ্রæপের গ্রæপ লিডার হলেন বেলুকুচি থানার তামাই গ্রামের এম.এ মান্নান, ডেপুটি লিডার নিযুক্ত হলেন শাহজাদপুর থানার রবীন্দ্র নাথ বাগচী। আমাদের কে তরঙ্গপুর থেকে অস্ত্র, গোলা-বারুদ, রেশনিং ও পকেট মানি দেওয়া হলো। মৃত্যু যে হবেনা এমন কোন গ্যারান্টি ছিল না। তাই আমি তরঙ্গপুর বাজার থেকে একখানা শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রন্থ, একটি বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও একটি ৪ ব্যান্ডের রেডিও কিনলাম। তরঙ্গপুর থেকে কালিয়াগঞ্জ পর্যন্ত বাসে এসে ট্রেনে উঠলাম। শিলিগুড়ি রেলওয়ে জংসন ষ্টেশনে এসে আমাদের ট্রেন বদলাতে হলো। আসাম গামী ট্রেনে উঠলাম। ভারতীয়রা আমাদেরকে জয় বাংলার লোক বলতো। সরকারি বাস ও ট্রেনে টিকেট চাইতে এলে “জয় বাংলা” বললেই আর টিকেট বা ভাড়া চাইতো না। আসাম গামী ট্রেনে ধুবরী নামক ষ্টেশনে আমরা নামলাম। ধুবরী থেকে বাস যোগে মানিকার চর এলাম। রাত হয়ে যাবার কারণে রাতে মানিকার চর একটা বডিং এ থাকলাম। পরদিন সকালে নদী পার হয়ে এলাম তদানীন্তন রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম মহকুমার (বর্তমানে জেলা) মুক্তাঞ্চলে স্থাপিত রৌমারী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। রৌমারী ক্যাম্পে আমরা ¯œান খাওয়া দাওয়া করলাম। আমাদের কমান্ডার স্যার সিরাজগঞ্জ জেলার মুক্তাঞ্চল যমুনার চড়ে পৌছানোর জন্য নৌকা ভাড়া করলেন। রৌমারী ক্যাম্প থেকে রাতের খাবার খেয়ে রাত ৯:০০ টার দিকে আমাদের নৌকা ছাড়লো। ইহা ছিল ৬ সেপ্টেম্বর’৭১। নৌকা বাহাদূরাবাদ ঘাটের সম্মূখ দিয়ে আসতে হয়। আমরা জানতে পেরে ছিলাম। বাহাদূরাবাদ ঘাট অত্যন্ত ঝুঁকি পূর্ণ এলাকা। ঐ ক্যাম্পের পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারেরা ভয়ানক। তারা স্পীড বোর্ট নিয়ে রাতে নদী টইল দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা পেলে ধরে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে নিয়ে অমানুষিক অত্যাচার করে নৃশংস ভাবে হত্যা করে। আমাদের কমান্ডার জনাব এম.এ মান্নান স্যার নির্দেশ দিলেন আপনারা সবাই নৌকার ডওরার মধ্যে পজিশন অবস্থায় থাকুন। পাকিস্তানি হায়েনারা ধরতে এলে আমরা ধরা দিব না। যুদ্ধ করবো। যুদ্ধ করে শহীদ হবো কিন্তু ওদের হাতে ধরা দিব না। রাত ২.০০ টার দিকে আমরা ঝুঁকি র্পূন বাহাদূরাবাদ ঘাট এলাকা অতিক্রম করতে থাকলাম। ওদের সার্চ লাইটের আলো এসে বার বার আমাদের নৌকাতে পড়ছিল। ভগবানের কৃপায়-ওরা আর স্পীড বোট নিয়ে ধরতে এলোনা। আমরা বাহাদূরাবাদ ঘাট এলাকা অতিক্রম করলাম। আমাদের সাথে চিড়া গুড় ছিল। ভোরে এক কাইসা খেতের মধ্যে নৌকা ডুকিয়ে দিয়ে প্রাত:ক্রিয়া করলাম। তার পর নৌকা ছাড়লো। তখন কাজিপুর থানা সহ নদী পথের অধিকাংশ এলাকা সহ সারা দেশের অধিকাংশ স্থান পাকিস্তানি হানাদারদের দখলে। কাজিপুর থানার সম্মুখ দিয়ে আমাদের নৌকা আসবে। দেখে শুনে থামিয়ে থামিয়ে ৪ দিন ভরে নৌকা এসে পৌছালো সিরাজগঞ্জ হানাদার মুক্তাঞ্চল যমুনার চরে। ইহা ছিল টাঙ্গাইল জেলার সিংগুলির চরের কাছাকাছি। নৌকাতেই রান্নার ব্যবস্থা ছিল। মাঝিরা কোন রকমে ডাল ভাত অথবা খিচুরী রান্না করে আমাদের খাওয়াতো। এই ভাবে খেয়ে না খেয়ে চলছিলাম। পরের দিন রাতে যমুনা নদীর এপাড়ে চলে এলাম। চলে এলাম বেলকুচি-কামারখন্দ নির্বাচনী এলাকার এম.এন.এ জনাব মো: আব্দুল মোমিন তালুকদারের গ্রামের বাড়িতে। তিনি তখন বাড়িতে ছিলেন না। তাঁর ভাই মো: রশিদ তালুকদার আমাদের থাকা খাওয়া ও অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতা করলেন। অক্টোবর’৭১ মাসের মাঝা মাঝির আগ পযর্ন্ত আমাদের গ্রæপের মুক্তিযোদ্ধা সংখ্যা কম থাকায় কোন সম্মূখ যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত কমান্ডার স্যার নেন নি। আমরা পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য ও তাদের দোসরদের আতঙ্কে রাখার জন্য গেরিলা কার্যক্রম “হিট এন্ড রান”চালাতাম। পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য বা রাজাকার ক্যাম্পের নিকট বর্তী গিয়ে ২/৪ টা থ্রি নট থ্র্রি রাইফেলের আকাশ মুখি গুলি ছুড়ে চলে আসতাম। পাকিস্তানি দালাল, পীচ কমিটির লোক ও অন্যান্যরা আমাদের অস্তিস্তের কথা জানতে পারতো। আমরা দিনের বেলা স্কুলে বা কারো বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকতাম। মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ে দেশের অভ্যন্তরে ছিল দুই পক্ষ। একটি স্বাধীনতার পক্ষে অন্যটি স্বাধীনতার বিপক্ষে। স্বাধীনতা বিপক্ষের পীচ কমিটির সদস্য,রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও অন্যান্যরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ কারীদের তথ্য দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে এসে বাড়িঘরে অগ্নি সংযোগ, লুটতরাজ, চাঁদাবাজি করতো। বাড়ির মালিকে ধরে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যা করতো। হিন্দু ও আওয়ামী লীগ নেতারা ছিল ওদের বড় টার্গেট। হিন্দু নারী পুরুষকে ধরে নিয়ে যেত। নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যা করতো। আমাদের মুক্তিযোদ্ধা গ্রæপ কোন স্বাধীনতা বিরোধীকে ধরি নাই বা হত্যা করি নাই। আমরা বুঝিয়ে বিভিন্ন ভাবে স্বাধীনতা বিরোধীদের স্বাধীনতার পক্ষে আনার চেষ্টা করতাম। আমাদের অধিকাংশ মুক্তি যোদ্ধা গ্রæপে পরিকল্পনা ছিল কোন মা-বোন ধর্ষণ করা, হত্যা করা, বাড়ি জ¦ালিয়ে দেওয়া ও অন্যান্য মানবতা বিরোধী কোন পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য ধরতে পারলে ফায়ারিং স্কোয়ার্ডে দেওয়া হবে। মুক্তি যোদ্ধাদের অধিকাংশ গ্রæপেই একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে জল্লাদ হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল। আমাদের গ্রæপের জল্লাদ হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন দৌলতপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মো: শামসুল হক। কিন্তু আমরা কোন পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যকে ধরতে পারি নাই। আমাদের সাথে সব সময় চিড়া গুড় থাকতো। কোন কোন দিন কোন বাড়িতে শেল্টারের অভাবে সারারাত চিড়া গুড় খেয়ে রাত্রি জেগে স্কুলের বেঞ্চে শুয়ে থাকতে হতো। বিছানা ও মশারী ছিল না। আমাদের নিজস্ব কোন হাড়ি পাতিল ছিল না। আমরা অন্যের বাড়িতে খেয়ে খেয়ে থাকতাম। আমাদের শেল্টার পালা ক্রমে দু’জন করে করে নিজেদের কে পাহাড়া দিতাম। প্রতি রাতে কমান্ডার স্যার আমাদের পাশ ওয়ার্ড দিতেন। আমরা রাতে বিভিন্ন রাজাকারদের বাড়িতে গিয়ে তাদের বুঝাতাম। সকালে আমরা অস্ত্রে ফুল থ্রু মারতাম ও পরিস্কার করতাম ও তেল দিতাম। তখন দেশের অধিকাংশ মানুষ ছিল স্বাধীনতার পক্ষে। তবুও আমাদের কে সহজ সরল মানুষ গুলো শেল্টার বা খাবার দিতে ভয় পেতেন। কারণ অধিকাংশ গ্রামেই ছিল পাকিস্তানি দালাল ও রাজাকার। তারা খোঁজ জানলে পাশর্^বর্তী আর্মি বা রাজাকার ক্যাম্পে সংবাদ দিয়ে তাদেরকে নিয়ে এসে বাড়িঘর জ¦ালিয়ে দিবে, বাড়ির মালিককে হত্যা করবে ও অত্যাচার চালাবে এই ছিল তাদের ভয়। স্থানীয় কিছু আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ট্রেনিং দেওয়ায়ে আমাদের সাথে নিলাম। আমি মুক্তিযুদ্ধে যাবার কারণে আমার পিতৃদেব ও মাতৃদেবী পাগল প্রায় হয়ে গিয়ে ছিলেন। আমাকে ফিরিয়ে আনার জন্য গোটা পরিবার ভীষণ ঝুঁকি নিয়ে ভারতের আসামের মানিকার চড় শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। আমার কমান্ডার স্যার ও অন্যান্য সাথীদের বলে রেখেছিলাম- আমি মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে আমার কমান্ডার ও রণাঙ্গনে সাথীদের বলে রেখেছিলাম। আমি রণাঙ্গণে মারা গেলে আমার শবদেহ তরঙ্গপুর বাজার থেকে কেনা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা দিয়ে জলে দিয়ে দিবেন। আমাদের গ্রæপের অস্ত্র ও গোলা-বারুদ আরো প্রয়োজন হওয়ায়। কামান্ডার স্যার তরঙ্গপুর থেকে অস্ত্র ও গোলা-বারুদ আনার জন্য সিরাজগঞ্জের এম.এন.এ জনাব মোতাহার হোসেন তালুকদার এর ভায়রা ঝাঐল গ্রামের মো: আব্দুল হামিদ তালুকদার কে পাঠালেন। মো:আব্দুল হামিদ তালুকদারের কাছে আমি আমার পিতৃদেব মাতৃদেবী ও পরিবারের অন্যান্যদের পরিচয় লিখে দিলাম। তিনি মানিকার চর শরণার্থী ক্যাম্পে আমার বাবা মা ও অন্যান্যদের সাথে দেখা করলেন। আমার পিতা-মাতা আমাকে মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মো: আব্দুল হামিদ তালুকদারের সাথে পাঠিয়ে দিলেন আমার মেজ দাদা সমরেন্দ্র নাথ সান্যাল কে। তিনি ১৪ নভেম্বর’৭১ দৌলতপুর গ্রামে মো: শামসুল হক এর বাড়িতে এসে আমাদের সাথে মিলিত হলেন। আমার মেজদাদা আমাদের কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী কে বললেন “আমার ভাই দেবেশের জন্য বাবা-মা প্রায় পাগল হয়ে গেছেন। ভাইকে ফিরিয়ে ভারতে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী আমার মেজ দাদা কে বললেন-“আপনিও আমাদের সাথে থাকুন, আপনাকে আমরা ট্রেনিং দেওয়ায়ে মুক্তিযুদ্ধ করার উপযুক্ত করে নিব। এখন ভারতে যাওয়া অত্যন্ত ঝুঁকি পূর্ণ। দেবেশের নামে অস্ত্র ইস্যু করা আছে। অল্প দিনের মধ্যে দেশ স¦াধীন হবে। কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী এর কথা মেজদা মেনে নিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন। মেজদাদা আমাদের কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী ও অন্যান্যদের কাছ থেকে ট্রেনিং নিলেন। কোথায়-ও আক্রমণের পূর্বে আমরা রেকী করে দেখতাম। তারপর আক্রমন করতাম। আমি দুই জন কমান্ডারের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছি। ১. গ্রæপ কমান্ডার জনাব এম এ মান্নান এর অধীনে আমরা ১, বেলকুচি থানা আক্রমন যুদ্ধ ২, কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ষ্টেশন সংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্প এ্যাম্বুস ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বহন করা ট্রেন ধংস করার পরিকল্পনায় অ্যাম্বুস। ডেপুটি কমান্ডার (গ্রæপ কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত) বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগচী এর অধীনে ৩, কল্যানপুর যুদ্ধ ও ৪, শাহজাদপুর উপজেলার ধীতপুর নামক যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছি। আমাদের প্রত্যেকটি যুদ্ধ ছিল ভয়াবহ। একটি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত পেশাদার ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা অত্যন্ত ঝুঁকি পূর্ণ। আমরা ‘জয় বাংলা’ বলে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তাম। অনেক মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি দালাল ও রাজাকারদের হত্যা করেছে। আমাদের গ্রæপ আমরা কোন রাজাকার বা স্বাধীনতা বিরোধী কে হত্যা করি নাই। আমাদের গ্রæপে নীতি ছিল আমরা কোন বাঙালিকে হত্যা করবো না। স্বাধীনতা বিরোধীদের বুঝিয়ে আমাদের পক্ষে আনবো। আমরা সকল যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছি। তা হলো
১. বেলকুচি থানা অপারেশন: বেলকুচি সিরাজগঞ্জ জেলার একটি উল্লেখযোগ্য থানা। অক্টোবর’৭১ মাসের শেষের দিকে আমরা এই থানা আক্রমণ করেছিলাম। এই থানা আক্রমণ যুদ্ধে নেতৃত্বে ছিলেন আমাদের গ্রæপ কমান্ডার জনাব এম.এ মান্নান স্যার। কমান্ডার স্যারের ও আরো ৩ জনের রেকিতে একযোগে বেলকুচি থানা ও বেলকুচি মুসলিমলীগ নেতা মোঃ আব্দুল মতিনের বাড়ি আক্রমন করলাম। সন্ধ্যায় বানিয়া গাতি গ্রামের এক বাড়ির শেল্টারে কমান্ডার স্যার বিস্তারিত ব্রিফ করলেন। কমান্ডার স্যার ঐ রাতের জন্য শাপলা ও গোলাপ পাসওয়ার্ড নির্ধারণ করে দিলেন। আমাদের দুই গ্রæপে ভাগ করে দিলেন। সিদ্ধান্ত হলো কমান্ডার স্যারের নেতৃত্বে বড় গ্রæপটি থানা আক্রমন করবে। অন্য গ্রæপটি রবীন্দ্র নাথ বাগ্চীর নেতৃত্বে মতিন সাহেবের বাড়ি আক্রমন করে মতিন সাহেবকে ধরে আনবে। আমি কমান্ডার স্যারের গ্রæপে থেকে থানা আক্রমন যুদ্ধে অংশ নিলাম। রাত ৯ টায় বানিয়া গাতি থেকে যাত্রা করলাম। থানার কাছে গিয়ে দু গ্রæপ টার্গেটে উদ্দেশ্যে ভাগ হলাম। নির্দিষ্ট সময়ে রাত ১২টায় একযোগে আক্রমনের সিদ্ধান্ত। পরিকল্পনা মোতাবেক রাত ১১.৫৫ মিনিটে থানার দিকে পশ্চিম পাশ দিয়ে স্ক্রোলিং করে থানার সামনে যেতেই সেন্ট্রি দেখে ফেললো। হুইসেল বাঁজিয়ে থানার সবাইকে জানিয়ে দিয়ে আমাদের কে লক্ষ্য করে গুলি করলো। আমাদের কমান্ডার স্যার কমান্ড করে ফায়ার ওপেন করলেন। আমরা সবাই একযোগে গুলি করলাম। প্রায় এক ঘণ্টা ব্যাপি গুলি ও পালটা গুলি চললো। ভয়া বহ যুদ্ধ। আমার মাথায় হেল মেট। আমি থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালাচ্ছিলাম। দুইটি গুলি এসে আমার হেলমেটে লাগলো। আমার ডান পার্শে^ আমার কমান্ডার স্যার। হয় বিজয় আর না হয় মৃত্যু ছাড়া কোন পথ নাই। বৃষ্টির মত গুলি ও পালটা গুলি চলছে। যুদ্ধের সময়ে এক সময়ে কমান্ডার স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- “দেবেশ, মাথা তুলো না, গুলি চালিয়ে যাও”। আমাদের বৃষ্টির মতো গুলিতে থানার বিহারী পুলিশ ও রাজাকার থানার পিছনদিক দিয়ে পালিয়ে সোহাগপুর যমুনা নদীতে থাকা একটি লঞ্চে চড়ে আমাদের রেঞ্জের বাইরে যমুনার মধ্যে চলে গেল। থানার সেন্ট্রি গুলি করা বন্ধ করে উচ্চ স্বরে সারেন্ডার,সারেন্ডার বলে দুই হাত উপরে তুলে আত্মসমর্পণ করলো।
আমরা থানার ভিতরে ঢুকে পড়লাম। আমাদের গ্রæপে দৌলতপুর গ্রামের মো: শামসুল হক রাজাকার দুই জন কে পিট মোরা করে বেঁধে বসিয়ে রাখলেন। আমরা থানার মাল খানা থেকে সকল অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিলাম। থানার দু’জন রাজাকারকে জ্যান্ত ধরে নিয়ে এলাম। ভোর হয়ে গেল। মতিন সাহেবের বাড়ি আক্রমন করা দলটিও এলো। মতিন সাহেব পালিয়ে গেছে। তাকে ধরা সম্ভব হয় নাই। থানার আশেপাশের লোকজন দোকান ও বাড়িতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে দিল। বিজয়ী হয়ে কিছু সময় বিজয় উল্লাস করলাম। তারপর চলে এলাম বেড়া খারুয়া গ্রামে। রাজাকাররা যাতে আমাদের শেল্টার চিনতে না পারে সেই জন্য তাদের চোখ বেঁধে শেল্টারে ঢুকানো হলো। পরদিন সিরাজগঞ্জ থেকে শতাধিক পাকি হানাদার সৈন্য ও রাজাকার এসে থানার আশে পাশে আগুন দিয়েছিল এবং মানুষদের নির্যাতন করেছিল। বেলকুচি থানা আক্রমণ যুদ্ধে আমরা ২ জন রাজাকার কে ধরে এনেছিলাম। রাজাকার ২ জন কে চোখ বেঁধে আমাদের শেল্টারে আলাদা রুমে রেখে ছিলেন। আমি কমান্ডার স্যারের অনুমতি নিয়ে ওদের সাথে কথা বার্তা বললাম। তাদের কে রাজাকার হওয়ার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম ও শুনলাম। ওদের সাথে জিজ্ঞাসা বাদে মনে হলো ওরা সহজ সরল ও অভাবী মানুষ। ওদের বাড়িতে স্ত্রী ও পুত্র কন্যা আছে। পীচ কমিটির লোকদের কথায় বিশ^াস করে ওরা রাজাকার হয়েছে। ওরা মনে করে ছিল এটা একটা চাকুরী। উপার্জন করে সংসার পরিচালনার জন্য ওরা রাজাকার হয়েছে। তারা বলল- “আমরা কাউকে কোনো অত্যাচার করি নাই। কোনো বাড়িঘর লুটতরাজ করি নাই। পাকিস্তানি হানাদারদের নিয়ে গিয়ে কোনো গন হত্যা করি নাই। কোনো বাড়িতে আগুন দেই নাই…”। তাদের কথায় আমার মায়া হলো। আমি তাদের চোখ বাঁধা খুলে দিলাম। তাদের কে বিভিন্ন ভাবে বুঝালাম। প্রতিজ্ঞা করালাম তারা আর রাজাকারে যাবে না। কথা বললাম-আমাদের কমান্ডার স্যারের সাথে। আমাদের কমান্ডার স্যার খুব ভালো মানুষ। আমি ছোট মানুষ হওয়াতে স্যার আমাকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসতেন। রাত্রিতে শেল্টার পরিবর্তনের সময় কমান্ডার স্যারে কে অনুরোধ করে রাজাকার দুই জনকে ছেড়ে দিয়ে ছিলাম।
২. কালিয়া হরিপুর অ্যাম্বুস :কালিয়া হরিপুর সিরাজগঞ্জ জেলার সদর থানার একটি রেলওয়ে স্টেশন। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষের দিকে আমরা কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ষ্টেশনের নিকট বর্তী ব্রীজে পাহাড়ারত রাজাকারদের এবং ঈশ^রদী থেকে সিরাজগঞ্জ গামী পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য ও গোলাবারুদ বহনকারী ট্রেন আক্রমণ করার জন্য অ্যাম্বুস করেছিলাম। এই এ্যাম্বুসের নেতৃত্বে ছিলেন গ্রæপ কমান্ডার জনাব এম.এ মান্নান স্যার। আমাদের গ্রæপের ঝাঐল গ্রামের সিরাজগঞ্জের এম,এন, এ জনাব মোঃ মোতাহার হোসেন তালুকদারের ভায়রা আওয়ামীলীগ নেতা জনাব মোঃ আব্দুল হামিদ তালুকদারের রেকির ভিত্তিতে কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ষ্টেশনে পাকিস্তানি সৈন্য ও ব্রীজ পাহাড়ারত রাজাকারদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ করা জন্য অ্যাম্বুস করেছিলাম। ঐ এ্যাম্বুসে যুদ্ধ হয় নাই। কমান্ডার স্যার ক্রোলিং করে রেল লাইনে ব্যাটারি চালিত বৈদ্যুতিক মাইন বসিয়ে এসেছিলেন। কমান্ডার স্যার ট্রেন উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করলেন। আমরা ধানক্ষেতের মধ্যে পজিশন অবস্থায় থাকলাম। কামান্ডার স্যারের হাতে মাইনের তার ও ব্যাটারী। টর্চ লাইট ও হ্যারিকেন হাতে পাকি মিলি শিয়া ও রাজাকারেরা ষ্টেশনে টহল দিচ্ছিল। ওদের পায়ে লেগে হঠাৎ আমাদের মাইনের তার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। মাইনটি ওদের নজরে পড়লো। হুইসেল দিয়ে রাজাকারদের পজিশনে রেডি থাকতে বললো। পাাকিস্তানি মিলেশিয়া আমাদের দিকে টর্চ লাইট মেরে মেরে খুঁজতে থাকলো আর উর্দূতে বকাবকি করতে থাকলো। ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জ গামী পাকি হানাদার বাহী একটি ট্রেন এলো। ষ্টেশনের পাকি হানাদারেরা সিগন্যাল দিল। ষ্টেশনে ট্রেনটি থামিয়ে দিল। ট্রেনের পাকি হানাদারেরা অস্ত্র তাক করা অবস্থায় নেমে আমাদেরকে খুঁজতে থাকলো। মাইনের বৈদ্যুতিক তার বিছিন্ন হয়ে পরায়। আমাদের মাইনটি ব্রাষ্ট করা সম্ভব হলো না। পাকি হানাদারদের সংখ্যাধিক্যতা ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে কমান্ডার স্যার উইথড্র হওয়ার কমান্ড করলেন। এই রাতে আমাদের গ্রæপের পাশওয়ার্ড ছিল জবা ও গোলাপ। আমরা কিছু দূর ক্রোলিং করে পিছিয়ে এসে উইথড্র হয়ে কমান্ডার স্যারের বাড়ি বেলকুচি থানার তামাই গ্রামে এলাম। পরের দিন সিরাজগঞ্জ থেকে পাকি হানাদার ও রাজাকারেরা এসে কালিয়া হরিপুর ও পাশর্^বতী কয়েকটি গ্রামের কয়েকটি বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল। কিছু লোকের উপর নির্যাতন চালিয়ে ছিল। আমরা কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ষ্টেশন এ্যাম্বুস থেকে ফিরে এসে তামাই গ্রামে কমান্ডার স্যারের বাড়িতে একত্রিত হই। আমাদের সবাইকে কমান্ডার স্যারের বাড়িতে বসিয়ে কমান্ডার স্যার ব্রিফ করলেন। স্থানীয় ভাবে ট্রেনিং দেওয়া বেশ কিছু যুবককে আমাদের গ্রæপে ভর্তি করা হয়েছিল। এত বড় প্লাটুন এক শেল্টারে শেল্টার নেওয়া সমস্যা। তাই কমান্ডার স্যার ডেপুটি কমান্ডার রবীন্দ্রনাথ বাগ্চী কে কমান্ডার করে আমাদের আর একটি গ্রæপ করে দিলেন। কমান্ডার স্যার নির্দেশ দিলেন- আমরা দুই গ্রæপ পরস্পর যোগা যোগ করে শেল্টার নিয়ে নিয়ে অবস্থান করতে থাকব। কোন পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য ক্যাম্প, থানা বা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত হলে একত্রিত হয়ে আক্রমণ করবো। রাতেই কমান্ডার স্যার এর বাড়ি থেকে রওনা হয়ে আমরা সারারাত হেঁটে বেলকুচি থানার কল্যানপুর গ্রামে এলাম।
৩. কল্যাণপুর যুদ্ধ: কল্যাণপুর সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার একটি গ্রাম। ৫ নভেম্বর’৭১ কল্যানপুর গ্রামে একটি যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধে নেতৃত্বে ছিলেন ডেপুটি কমান্ডার (কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত) বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগ্চী। কমান্ডার স্যারের নির্দেশে আমরা ১১ জন রবীন্দ্র নাথ বাগ্চীর কমান্ডনাধীন হয়ে হেঁটে ভোরে বেলকুচি উপজেলার কল্যাণপুর নামক গ্রামে এক বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। বাড়ির মালিক আমাদের সকালের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। আমরা সারারাত নিদ্রাহীন থেকেও হেটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। সকালের খাবার খেয়ে প্রকাশ্যে পিটি, প্যারেড করলাম। অস্ত্র পরিষ্কার করলাম। অস্ত্রে ফুলথ্রু মারলাম। একজন করে করে আমাদের অবস্থান পাহাড়া দিতে থাকলাম। অন্যান্যরা কেহ কেহ ঘুম বা রেষ্টে থাকলাম। কল্যানপুর একটি নিভৃত গ্রাম। আমাদের ধারনা ছিল এই গ্রামে পাকি হানাদার ও রাজাকার আসবে না। বেলা ১০টার দিকে সেন্ট্রিরত সহযোদ্ধা রতনকুমার দাস দৌড়ে এসে জানালেন আমদের কে ধরার জন্য বেলকুচি থানা থেকে কয়েকজন পাকি হানাদার মিলে শিয়া ও রাজাকার আসছে। বওড়া গ্রামের মধ্য দিয়ে কল্যানপুরের দিকে আসছে। দুইজন পাকিস্তানি দালাল গামছা দিয়ে মুখ বেধে নিয়ে হানাদার ও রাজাকারদের পথ চিনিয়ে নিয়ে আসছে। দূর থেকে অনুমান হলো এই দলে ৫জন মিলেশিয়া ও ৪ জন রাজাকার আছে। আমাদের কমান্ডার যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমরা কল্যানপুর গ্রামের রাস্তার ধারে বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে পজিশন নিলাম। বাঁশ ঝাড়ের সামনে দিয়ে চলা রাস্তা ধরে পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারেরা আসছিল। আমাদের রেঞ্জের মধ্যে আসার সাথে সাথে আমাদের কমান্ডার রবীন্দ্রনাথ বাগ্চী কমান্ড ও ফায়ার ওপেন করলেন। আমরা এক যোগে গুলি করা শুরু করলাম। এক লাফে হানাদারেরা রাস্তার উত্তর পার্শে¦ পজিশন নিল। ওরাও আমাদের লক্ষ্য করে গুলি চালালো। আমরাও একযোগে বৃষ্টির মতো গুলি ছাড়তে থাকলাম। গোলাগুলির শব্দ পেয়ে আশে পাশে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা গ্রæপ আমাদেরকে সহযোগীতা করার জন্য এগিয়ে এলেন। প্রয় এক ঘণ্টার মত সময় সম্মুখ যুদ্ধ চললো। তারপর পাকি হানাদারেরা পিছিয়ে গেল। যুদ্ধে জয়ী হয়ে আমরা বিজয় উল্লাস করলাম। সকল স্তরের মানুষের আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হলো। এক বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করলাম। তারপর হেটে দৌলতপুর গ্রামের সহযোদ্ধা মুক্তি মোঃ শামসুল হকের বাড়িতে শেল্টার নিলাম। ১৪ নভেম্বর’৭১ এই শেল্টারে আমার মেজো দাদা সমরেন্দ্র নাথ সান্যাল আমাদের সাথে যোগ দিলেন। আমরা কয়েক দিন দৌলতপুর, তেঞাশিয়া, খুকনী, বাজিয়ারপাড়া, দরগার চর ও অন্যান্য গ্রামে থাকতে থাকলাম।
৪. ধীতপুর যুদ্ধ: ধীতপুর সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর থানার একটি গ্রাম। এই যুদ্ধে নেতৃত্বে ছিলেন ডেপুটি কমান্ডার (কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত) বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগ্চী। ১২ডিসেম্বর’৭১ রাতে আমাদের শেল্টার ছিল সৈয়দপুর গ্রামের কালা চক্রবর্ত্তী, আখর হাজী ও অণ্যান্যের বাড়িতে। ১৩ ডিসেম্বর’৭১ বেলা ১২.০০ টার দিকে সংবাদ পেলাম পাকি হানাদারেরা কৈজুরী হয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। টাঙ্গাইলের যুদ্ধে পাকি হানাদারেরা পরাজিত হয়ে লঞ্চে যমুনা নদী পাড় হয়ে মালিপাড়া ক্যাম্পে এসে ছিল। মালিপাড়া ক্যাম্প থেকে রাস্তা চিনানোর জন্য দুই জন রাজাকারকে সঙ্গে নিয়ে এসে ছিল। আমরা পাকি হানাদারদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য ওদের পিছু নিলাম। ওরা ক্ষুধার্ত। কৈজুরী গ্রামের একজনের মুলা ক্ষেত থেকে মুলা খাওয়ার চেষ্টা করলো। ওরা হয়তো জানতো না কাঁচা মুলা খাওয়া যায় না। ওয়াপদা বাঁধ ধরে ওরা অগ্রসর হতে লাগলো। আমরাও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ওদের পিছু পিছু যাচ্ছিলাম। ওরা ভীষণ ক্রোধী। ধীতপুর নামক স্থানে গিয়ে ওরা আমাদের দিকে অস্ত্র তাক করলো। আমরা জাম্প করে ওয়াপদা বাঁধের পশ্চিম দিকে পজিশন নিলাম। পাকিস্তানি হানাদারেরা ওয়াপদা বাঁধের পূর্ব পার্শ্বে পজিশন নিল। ওরা আমাদের অপর গুলি চালাল। আমরাও ওদের উপর গুলি চালালাম। প্রায় এক ঘণ্টা ব্যাপি গুলি পাল্টা গুলি চলতে থাকলো। গুলির শব্দে শাহজাদপুর, চৌহালী, বেলকুচি ও বেড়া থানার বিভিন্ন স্থানে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা দল আমাদের সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে এলো। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। হানাদারেরা গুলি করা বন্ধ করলো। আমরাও অন্ধকারে গুলি করা বন্ধ করে দিয়ে ছিলাম। রাত ১১ টার পর পাকিস্তানি হানাদারেরা ক্রোলিং করে পিছিয়ে গিয়ে বেড়া নদী পাড় হয়ে নগর বাড়ি হয়ে ঢাকা চলে গিয়েছিল। দুই জন রাজাকার সারারাত মাঝে মাঝে কাভারিং ফায়ার করেছিল। আমরাও তাদের ফায়ারের উত্তরে মাঝে মাঝে ফায়ার করে ছিলাম। আমরা না খেয়ে পজিশন অবস্থায় ছিলাম। আমাদের গ্রæপটি ছিল বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগচী এর কমান্ডানাধীন। যুদ্ধটি ছিল পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধে আমি থ্রি-নট থ্রি রাইফেল চালাচ্ছিলাম। আমার বাম পাশের্^ অবস্থান নিয়ে এল এম জি চালাচ্ছিলেন আমাদের কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী। আমার ডান পাশের্^ অবস্থান নিয়ে থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালাচ্ছিলেন আমার মেজ দাদা সমরেন্দ্র নাথ সান্যাল। তাঁর ডান পাশের্^ অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ করছিলেন- কাদাই বাদলা গ্রামের ১. মো: নজরুল ইসলাম, ২. দৌলতপুর গ্রামের মো: শামসুর হক, ৩. শাহজাদপুরের পুকুর পাড় গ্রামের রতন কুমার দাস, চৌহালী থানার মিরকুটিয়া গ্রামে মো: নজরুল ইসলাম ও আমাদের গ্রæপের অন্যান্যরা। আমাদের গ্রæপের ডান পাশের্^ অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ করছিলেন বেড়ার এস এম আমির হোসেন এর গ্রæপ ও অন্যান্য গ্রæপ। আমাদের গ্রæপের বামপাশের্^ অবস্থান ছিল ঘাটা বাড়ির জনাব বজলুর রহমান (দুলাল) এর গ্রæপ। আমাদের যুদ্ধের সংবাদ পেয়ে রতন কান্দি গ্রামের জনাব এস এম রেজাউল করিম হেলাল, কাদাইবাদলা গ্রামের জনাব মো: সেরাজুল ইসলাম, উল্টা ডাব গ্রামের জনাব মো: আব্দুল হাই সাহেবের গ্রæপ সহ অন্যান্য গ্রæপ এই যুদ্ধে অংশ গ্রহন করে ছিলেন। ভোরে আমাদের কমান্ডার ও বেড়ার কমান্ডার ক্রোলিং করে ধীতপুর দাতব্য চিকিৎসালয়ে গিয়ে রাজাকার দুই জন কে আত্মসমর্পণ করিয়ে ছিলেন। এই রাজাকার দুই জনের নাম ছিল লতিফ ও কালাম। এই যুদ্ধটি ছিল ভয়াবহ যুদ্ধ এই ভয়াবহ যুদ্ধে বেড়া থানার বৃশালিকা গ্রামের অধিবাসী বেড়া বিবি হাই স্কুলের এর দশম শ্রেণীর ছাত্র মো: আব্দুল খালেক ও ছেচানিয়া গ্রামের বাসিন্দা মো: আমজাদ হোসেন গুলিবৃদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। পরে দুই জনই শহিদ হয়েছেন। ঐ দিন স্থানীয় দুজন পথচারী গোলাগুলির সময়ে গুলি বৃদ্ধ হয়ে ওয়াপদা বাঁধের উপর মারা গিয়ে ছিলেন। আমাদের অন্যান্য গ্রæপের চার জন আহত হয়ে ছিলেন। ধীতপুর যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে আমরা জামিরতা হাই স্কুলে ক্যাম্প করে অবস্থান নিয়ে ছিলাম। ১৪ ডিসেম্বর’৭১ শাহজাদপুর থানা হানাদার মুক্ত হয়ে ছিল। ১৬ ডিসেম্বর’৭১ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে) পাকিস্তানি হানাদারেরা মাথা নিচু করে আত্মসমর্পণ করে ছিল। ১৭ ডিসেম্বর’৭১ ভারতীয় বিমান বাহিনী বাংলাদেশের আকাশ পথ ঘুড়ে যুদ্ধত্তোরস্বাধীন বাংলাদেশের অবস্থা দেখে ছিল। ০৮ জানুয়ারী’৭২ জাতির পিতা পাকিস্তানের কারাগার হতে মুক্ত হয়ে লন্ডন ও ভারত হয়ে ১০ জানুয়ারী’৭২ দেশে আসলেন। ১১ জানুয়ারী’৭১ জাতির পিতা অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসাবে সংবিধান জারি করেন। ১২ জানুয়ারী জাতির পিতা প্রথমে রাষ্ট্রপতি হিসেবে এবং পরক্ষণেই রাষ্ট্রপাতি পদের ইস্তেফা দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রথা চালু করে প্রধান মন্ত্রী হিসাবে দেশের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করলেন। জাতির পিতা আমাদেরকে অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। আমাদের গ্রæপ ২৪ জানুয়ারী’৭২ রবিবার সিরাজগঞ্জ সদরস্থ ইব্রাহিম বিহারী বাসায় অস্ত্র ও গোলা বারুদ জমা দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব শেষ করে ছিলাম। সরকার থেকে ন্যাশনাল মিলেশিয়া ক্যাম্প স্থাপন করা হলো। আমাকে ন্যাশনাল মিলেশিয়া ক্যাম্পের ভর্তির পরামর্শ দিয়ে ছিলেন। আমি ন্যাশনাল মিলেশিয়া ক্যাম্পে ভর্তি হলাম না। বাড়িতে চলে এলাম। ১০ ফেব্রæয়ারী’৭২ সিরাজগঞ্জ মহকুমা কার্যালয় থেকে জেনারেল এম. এ.জি ওসমানীর একটি সনদ, একটি সাদা কম্বল ও বকেয়া পকেট মানি ও রেশনিং মানি হিসেবে ১১০/- টাকা দেওয়া হলো। বাড়ি এসে রতন কান্দি নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমার বড় দাদা দেবেন্দ্র নাথ সান্যাল এর কাছ থেকে অষ্টম শ্রেণির অটোপাশের টিসি নিয়ে শাহজাদপুর বহুপার্শি^ক উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে (বিজ্ঞান) ভর্তি হয়ে লেখা-পড়া শুরু করেছিলাম।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযোদ্ধার পরিচিতি: বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল,পিতা: দ্বিজেন্দ্র নাথ সান্যাল, মাতা: নিলীমা সান্যাল, গ্রাম ও ডাকঘর: রতন কান্দি,ইউনিয়ন: হাবিবুল্লাহনগর,উপজেলা: শাহজাদপুর, জেলা: সিরাজগঞ্জ। গেজেট নং-বে-সামরিক সিরাজগঞ্জ-১৬৭৯। ভারতীয় প্রশিক্ষণ – এফ.এফ. নং-৪৭৪২।
Leave a Reply