স্টাফ রিপোর্টার : মহান মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি পুরুষ, কীর্তিনারায়ণ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা, অধুনালুপ্ত দৈনিক মাতৃভূমি পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক, নবীগঞ্জের তথা বৃহত্তর সিলেটের কৃতি সন্তান প্রয়াত মেজর (অব:) সুরঞ্জন দাশ ও তাঁর সহধর্মিণী কীর্তিনারায়ণ কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত সুপর্ণা দাশ’র প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী আজ।
গতবছর আজকের এই দিনে কানাডার ভাঙ্কুভার শহরে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় স্বস্ত্রীক নিহত হন তিনি। কানাডার স্থানীয় সময় শুক্রবার সকাল ১০ টার দিকে কানাডার ভেরনন এর একটি ক্যাডেট ক্যাম্পের কাছে এ দুর্ঘটাটি সংঘটিত হয়। তার মৃত্যুর খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়লে সর্বমহলে শোকের ছায়া নেমে আসে।
হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার করগাঁও ইউনিয়নের গুমগুমিয়া গ্রামের কীর্তিনারায়ন দাস ও সেমাঙ্গীনি দাসের পুত্র সুরঞ্জন দাস ১৯৫১ইং সালের ১৫ জুন গুমগুমিয়া গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। ছোট বেলা থেকেই তিনি দুঃসাহসী ছিলেন। প্রাইমারীর পাঠ চুকান গ্রামের প্রাইমারী স্কুল থেকে। হবিগঞ্জ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ইং সালে লেটার মার্কসহ ১ম বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৭০ইং সালে হবিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃন্দাবন সরকারি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে আইএসসি পাশ করেন। এর পর চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইংরেজীতে অনার্সে ভর্তি হন। ছাত্র জীবনে সক্রিয় রাজনীতির সাথে জড়িত না থাকলেও রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলেন। ছাত্রদের দাবি-দাওয়া নিয়ে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছেন সেই সময়। ১৯৭১ইং সালের ২৩ মার্চ তিনি চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে করে শায়েস্তাগঞ্জ ষ্টেশনে এসে নামেন। সেখান থেকে হবিগঞ্জ শহরে যান। ভাত খাওয়ার জন্য হবিগঞ্জ শহরের তৎকালীন রাজনৈতিক হোটেল হিসেবে পরিচিত অন্নপুন্না হোটেলে যান। সেখানে দেখা হয় নবীগঞ্জের কৃতিসন্তান তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্রাচার্য্যের সাথে। পুর্ব পরিচিত হওয়ায় তিনি তাকে কাছে ডেকে নেন এবং লেখাপড়ার খোঁজ খবর নেন এবং ভালো করে লেখাপড়া করার পরামর্শ দেন। তিনি আমেরিকা যাওয়ার জন্য ঢাকা যাচ্ছিলেন। কিন্তু ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হয়েছিলেন। তিনি পরে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান সিলেটে। তখন তিনি সিলেট গিয়ে তার বন্ধু রঞ্জিত কুমার দাশের বাসায় উঠেন। ২৫ মার্চ রাতে সারা দেশের ন্যায় সিলেটেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালায়। পরদিন সকালে পরিস্থিতি বুঝার জন্য সুরঞ্জন দাস বাহিরে বের হন। শুনতে পান শুধু গুলাগুলির আওয়াজ। দোকান-পাঠ বন্ধ। ভয়ে পুনরায় ঘরে ফিরে আসেন। ৪৮ ঘন্টা পর কি করবেন কোন কিছু ঠিক করতে পারছিলেননা। তখন তার সাথে ছিলো নৃপেন্ড দাশ, রঞ্জিত দাশ, শিব প্রসাদ চৌধুরী ও প্রসঞ্জিত দাশ। তাদের সাথে নিয়ে সাহস করে বের হন। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ব্রীজের কাছে এসে দেখতে পান শুধু লাশ আর লাশ পড়ে রয়েছে মাটিতে। সেখান থেকে পায়ে হেটে চলে যান গোয়ালা বাজারের মোবারকপুর গ্রামে। মোবারকপুর গ্রামের ২/১ মাইল দুরে এক আত্মীয় বাড়িতে রাত্রিযাপন করে সকালে সড়ক পথে না গিয়ে হাওড় ও ধান তে হয়ে পরে নৌকাযোগে জগন্নাথপুর থানার রানীগঞ্জ হয়ে নিজ গ্রামের বাড়ি গুমগুমিয়া পৌঁছান। ১৯৭১ইং সালের ১৭ এপ্রিল বৈশাখ মাস। সুরঞ্জন দাস গ্রামের নিকটবর্তী শৌলাগড় হাওড়ে কাজ করছিলেন। এ সময় দেখতে পান মাথার উপর দিয়ে মহু মহু শব্দে যুদ্ধ বিমান চলাচল করছে এবং সেইসব বিমান থেকে মাঝে মধ্যে তাদের লক্ষ্য বস্তুতে বোমা ফেলছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এ খবরও জানতে পারেন লোখমুখ থেকে। তখন থেকে তিনি চিন্তায় পড়ে যান এবং কি করবেন ভাবতে শুরু করেন। রাতে ঘুম আসে না। পরিদন সকাল বেলা চলে যান তার বাল্যবন্ধু/সহপাঠী সুকুমার দাশের বাড়িতে (পরবর্তীতে তিনি করগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন)। তার কাছে গিয়ে বলেন যা শুরু হয়েছে তাতে সবাইকে তো এমনি এমনি মরতে হবে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যুদ্ধে যাবেন। তখন তিনি সুকুমার দাশের মতামত জানতে চান এবং তার সাথে সুকুমার দাশ যাবেন কি না জানতে চান। এ সময় সুকুমার ৬/৭ দিন সময় চায় সুরঞ্জন দাসের কাছে। এক সপ্তাহ পর সুকুমার দাশ তার সিদ্ধান্ত জানান। তিনিও যুদ্ধে যাবেন বলে জানান। তখন তারা দু’জন মিলে সিদ্ধান্ত নেন একটি টিম গঠন করতে হবে। যেই কথা সেই কাজ। সুরঞ্জন দাস ও তার বন্ধু সুকুমার দাশ, তার ভাতিজা শ্রীকৃষ্ণ দাস, বাবুল দাশ, অবনী কুমার দাশ সাদকপুর গ্রামের সুধা দাশসহ ৯ জনের একটি টিম গঠন করেন। বাড়ি থেকে ব্যবহারের জন্য সামান্য কাপড় চোপড় ও কিছু টাকা-পয়সা নিয়ে নৌকা যোগে ও দীর্ঘ সময় পায়ে হেটে এক পর্যায়ে বর্ডার ক্রস করে বালাট পৌঁছেন। প্রথম দিন ক্যাম্পের পাশে অন্য এক জায়গায় রাত্রিযাপন করেন। পরদিন সকালে ট্রানজিট ক্যাম্পে যাবার প্রস্তু’তি নিচ্ছেন, এ সময় তার সাথে যারা গিয়েছিল তাদের মধ্যে কারো পেটে ব্যাথা, কারো বুকে ব্যাথা বলে ক্যাম্পে না যাওয়ার কথা বলেন। কোনভাবেই তারা যাবে না। পরে তিনি একাই যাবেন বলে তাদের জানান। এক পর্যায়ে সুকুমার দাশ তার সাথে যাওয়ার জন্য রাজি হন। পরদিন সকলেই রিফিউজি ক্যাম্পে চলে যায়। বাকি থাকেন শুধু সুরঞ্জন দাস ও সুকুমার দাশ। তিনি যুদ্ধে যাবেনই এ সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। সুকুমার দাশকে বলেন দেখ তুই যাবে কি না বল আমি যাবই। আমি কোন ভাবেই রিফিউজি ক্যাম্পে যাবো না। পরে সুকুমার দাশও রাজি হয়ে যান। কিভাবে ট্রানজিট ক্যাম্পে যোগ দিবেন সে জন্য পাশের এলাকা বেলাতে পৌঁছে সেখানে তিনি হেমেন্দ্র পুরকায়স্থকে (পুর্ব পরিচিত) পেয়ে যান। তিনি আমাদেরকে শিলং এর অদুরে ইকো-১ ট্রেনিং সেন্টারে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন। ট্রেনিং শেষ করে তিনি তাদেরকে তামাবিল পাঠান। তৎকালীন কর্ণেল শওকতের নেতৃত্বে ৫নং সেক্টরে যুদ্ধ চলছিল। ছাতকে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানি মেলেটারি ছিল। একটির নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন ক্যাপ্টেন আকবর এবং অপরটির নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন ক্যাপ্টেন আনোয়ার। তাদের অধীনেই যুদ্ধে অংশ নেন সুরঞ্জন দাস ও সুকুমার দাশ। ১ম দিকে ভোলাগঞ্জ, চেলা, রাধানগর এলাকায় সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন। পরবর্তীতে দোয়ারাবাজার, টেংরাটিলা, ছাতক সিমেন্ট ফ্যক্টরী অঞ্চলে যুদ্ধে অংশ নেন। নোয়ারই (ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরীর কাছে) নামে একটি জায়গা আছে যেখানে ১১ অক্টোবর ১৯৭১ এর এক সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চতুর্মুখী আক্রমণে সারেন্ডারের সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছিল। এ সময় মিলিটারির সুবেদার ওয়াব ও সুরঞ্জন দাস সারেন্ডার করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। তিনিসহ তার বেশ কয়েকজন সহযোগী সারেন্ডার করবেন না প্রয়োজনে জীবন দিয়ে দিবেন তবুও হার মানবেন না বলে আর্মির অফিসারদের জানান। পরে সবাই মিলে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত হয়। সুরঞ্জন দাস ও সুকুমার দাশের উপর দায়িত্ব বর্তায় পাকিস্তানিদের অবস্থানের সঠিক তথ্য সংগ্রহের। জীবন বাজি রেখে হানাদার বাহিনীর অবস্থানের তথ্য নিশ্চত করেন। ১৪ আগষ্ট সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যপ্টেন হেলাল, সুরঞ্জন দাস ও সুকুমার দাশসহ ১৫০ থেকে ২০০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা মর্টার সেলসহ পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমন করেন। এ ঘটনায় অনেকেই হতাহত হন। এ অপারেশনে সুরঞ্জন দাস ছাড়াও তৎকালীন ল্যপ্টেন্যান্ট আব্দুর রউফ, ক্যাপ্টেন মহসীন, ক্যাপ্টেন আনোয়ার, কর্ণেল আকবরও ছিলেন। এরকম অনেক যুদ্ধে তিনি বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন।
যুদ্ধ শেষে সুরঞ্জন দাস এক সময় সেকেন্ড লেপ্টেন্যন্ট হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সেনাবাহিনীতে অত্যন্ত সুনামের সহিত চাকুরী করেন। পরবর্তীতে তিনি সর্বশেষ মেজর পদে পদোন্নতি লাভের পর ১৯৮২ইং সালে একমাত্র বাঙালী সেনা অফিসার হিসেবে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যান এবং সেখানে ১৮ মাস অবস্থান করেন। ১৯৮৪ইং সালে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৮৭ইং সালের জুন মাসে স্বেচ্ছায় অকালীন অবসর গ্রহন করেন। পরে ১৯৮৮ইং সালের ২৩ জুন পরিবারের সকলকে নিয়ে আমেরিকা চলে যান। সেখানে কিছু দিন থাকার পর তিনি স্বপরিবারে কানাডা চলে যান। সর্বশেষ তিনি পরিবারের সকলকে নিয়ে কানাডাতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছিলেন। তিনি বিয়ে করেন খুলনা জেলায়। তার স্ত্রী সুপর্ণা দাসও একজন উচ্চ শিক্ষিত মহিলা ছিলেন। মাস্টার্স পাশ করা সুপর্ণা দাস কানাডায় চাকুরী করতেন ভ্যঙ্কুভার এয়ারপোর্টে। তাদের ৩ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তান রয়েছে। ছেলে মেয়েরাও যার যার অবস্থানে আছে সগৌরবে। বড় মেয়ে শর্মিষ্টা দাস সুমি পেশায় একজন ডাক্তার। তিনি এম.ডি. ও এফ.আর.সি.এস. ডিগ্রিধারী। দ্বিতীয় মেয়ে শাওন দাস একজন নামকরা ব্যারিষ্টার। দু’জনেই বিবাহিত। তাদের স্বামীরাও উচ্চ শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত। একমাত্র ছেলে রাহুল দাসও পেশায় একজন ডাক্তার। সার্জারীতে অভিজ্ঞ রাহুলও এম.ডি. ও এফ.আর.সি.এস. ডিগ্রীধারী। তার সব ছোট মেয়ে শ্যামা দাসও এম.ডি. ও এফ.আর.সি.এস. ডিগ্রিধারী একজন নামকরা ডাক্তার।
তিনি কানাডায় চলে গেলেও তার মনপ্রাণ পড়ে থাকতো সবসময় বাংলাদেশে। তাই মাতৃভূমির টানে তিনি দেশে ফিরে আসেন ১৯৯৬ইং সালে। দেশের জন্য কিছু একটা করবেন এ মানসিকতা নিয়ে কাজ করতে থাকেন। রাষ্ট্রীয় কোন সুযোগ সুবিধা গ্রহন না করেও তিনি ১৯৯৮ইং সালে দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করে “দৈনিক মাতৃভূমি” নামে ঢাকা থেকে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। সাথে সাথে তার জন্মস্থান নবীগঞ্জে এসে সাধারণ অসহায় বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধা ও তাদের পরিবারের লোকজনদের খোঁজ খবর নিতে শুরু করেন। অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের ছেলে মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থাসহ নানাভাবে সহযোগিতা করতে থাকেন। এছাড়া নানান সামাজিক কমর্কান্ডে অংশ গ্রহন শুরু করেন। নবীগঞ্জ উপজেলার ভাটি অঞ্চল হিসেবে পরিচিত জগন্নাথপুর, সোনাপুর, হলিমপুর, আমড়াখাইসহ ওই এলাকার লোকজনের বাচ্ছাদের উচ্চ শিক্ষার কথা চিন্তা করে সেখানে তার পিতা কীর্তিনারায়ন দাসের নামে একটি কলেজ প্রতিষ্টা করেন। সেই কলেজ এখন ছাত্র/ছাত্রীদের কল-কাকলিতে মুখরিত থাকে। এতেই আনন্দ উপভোগ করতেন তিনি। কলেজ প্রতিষ্ঠা ছাড়াও বিভিন্ন শিশুদের জন্য প্রতিষ্টান, মসজিদ, মন্দিরে ভবন নির্মাণসহ বিপুল পরিমানে আর্থিক অনুদান আজীবন দান করে গেছেন।
Leave a Reply