কুটিশ্বর দাশ : যাঁর জীবন ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত
সুকেশ চক্রবর্ত্তী সৈলেন
নবীগঞ্জ উপজেলায় বিভিন্ন সময়ে যে স্বল্প সংখ্যক মহৎপ্রাণ ব্যক্তিদের কর্মকান্ড আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য এক দিকদর্শন হিসেবে কাজ করছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম স্বর্গীয় কুটিশ্বর দাশ (১৯২৪-১৯৯৫)। আমার বাড়ি শিবপাশা গ্রামে ও স্বর্গীয় কুটিশ্বর দাশ মহাশয়ের বাড়ি মুক্তাহার গ্রামে। আমি জাতিতে ব্রাম্মণ এবং আমরা পারিবারিকভাবে তাঁদের পরিবারের পুরোহিত। কিন্তু আমাদের মধ্যে যজমান-পুরোহিতের সম্পর্কের উর্ধ্বে ছিল পারিবারিক সম্পর্ক। ছোটবেলা থেকেই ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এই মানুষটার প্রতি ছিল আমার আগ্রহ ও শ্রদ্ধাবোধ। একদিন পূজা করতে গিয়ে গল্পের ছলে তাঁর একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতকার নিই। নিম্নে এর সারাংশ উপস্থাপন করিলাম।
কুটিশ্বর বাবু ছাত্রজীবনে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। ছোট বেলা থেকেই তিনি পত্রিকা পড়তেন (যদিও সে সময়ে তা ছিল রেয়ার)। একবার কোনও কাজে চট্টগ্রাম যাচ্ছেন ট্রেনে চড়ে, পড়ছেন পত্রিকা। হঠাৎ দেখতে পেলেন একটি চাকুরীর বিজ্ঞাপন এবং চাকুরীটাও বেশ দামী। অথচ এই দিনই আবেদন করার শেষ তারিখ। তিনি ট্রেন থেকে নেমেই উপস্থিত হন উক্ত স্থানে এবং অফিসে কর্মরতদের কাছ থেকে একটা কাগজ সংগ্রহ করে দাঁড়িয়েই ইংরেজিতে দরখাস্থ লেখেন ও জমা দেন। উপস্থিত লোকজন তাঁর লেখা ও ইংরেজিতে দক্ষতা দেখে চমৎকৃত হয়ে তাঁকে বললেন- ‘আপনি কি এই চাকুরী করবেন?’ তিনি বললেন- ‘হ্যাঁ করার ইচ্ছা আছে।’ কিছুদিন পর বাড়ির ঠিকানায় চিঠি আসে ঐ অফিস থেকে। চিঠিটি ছিল চাকুরীতে যোগদানের পত্র। কিন্তু তাঁর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাঁর বাবা ও পরিবারের অন্যান্যদের কথায় আর যোগদান করা হয় নি।
পরবর্তিতে তিনি সমাজকে সুশিক্ষার আলোয় আলোকিত করার প্রয়াস নিয়ে নবীগঞ্জ জে, কে হাইস্কুলে ১৯৫১ সালে সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করেন। তাঁর পদবীটি পন্ডিত শিক্ষকের হলেও ইংরেজিতে পারদর্শী হওয়ার কারনে তাঁকেই ইংরেজির ক্লাশ নিতে হতো। কয়েক বছরে তিনি বেশ নামকরা শিক্ষকে পরিনত হন। এমনি করে একদিন এই হাইস্কুলেরই প্রাক্তন শিক্ষক (যিনি কুটিশ্বর বাবুরও শিক্ষক ছিলেন) পন্ডিত শৈলজা রঞ্জন চক্রবর্ত্তী আসেন হাইস্কুলে। তিনি ইতিপূর্বে অবসর নিয়ে শিবপাশা গ্রামের তাঁর পৈত্রিক বিশাল বাড়ি বিক্রি করে ভারত চলে যান। বেশ কয়েক বছর পর আবার দেশে ফিরে আসেন। দেখা করেন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক শশী মোহন দেব মহাশয়ের সাথে এবং হাইস্কুলে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু প্রধান শিক্ষক শশী মোহন দেব মহাশয় তাঁকে জানালেন- ‘আপনি যে পদটিতে যোগদান করতে চাইছেন, সে পদে আছেন কুটিশ্বর বাবু। আর এই মুহুর্তে আরেকজন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার মতো ফান্ডও হাইস্কুল কর্তৃপক্ষের নেই। অতএব আপনাকে আমরা নিয়োগ দিতে পারছি না।’ এ বিষয়টি কুটিশ্বর বাবু জানতে পারেন, এবং এও জানেন যে তাঁর এই শিক্ষক অর্থ কষ্টে ভোগছেন। তাই তিনি আর কাল বিলম্ব না করে (১৯৫৪ সালে) প্রধান শিক্ষকের কাছে তাঁর রিজাইন লেটার দিয়ে দেন। ফলশ্রুতিতে পন্ডিত শৈলজা রঞ্জন চক্রবর্ত্তী নিয়োগ প্রাপ্ত হন। শিক্ষকের প্রতি এই প্রকার শ্রদ্ধাবোধ ও ত্যাগ সত্যিকার অর্থেই অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
পরবর্তী জীবনে তিনি সবার আশীর্বাদ নিয়ে করগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে বিচার-সালিশ ও আর্ত সামাজিক প্রেক্ষাপটে স্মরণীয় কীর্তি রেখে গেছেন। তাই কুটিশ্বর বাবু আজও তরুন প্রজন্মের জন্য অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে আছেন, থাকবেন। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি হোক এই প্রার্থনা।
লেখক: সেনেটারী ইন্সপেক্টর, নবীগঞ্জ পৌরসভা, হবিগঞ্জ।
Leave a Reply